মঙ্গলের চৌম্বকীয় স্তর অত্যন্ত দুর্বল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুদূর অতীতে কোনও এক বৃহদাকার উল্কাপিণ্ডের আঘাতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে মঙ্গলের এই চৌম্বক শক্তি। যার জন্য এই গ্রহে ‘ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট’ এর কোনও অস্তিত্ব নেই। এই বেল্টের অভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আগত মুহুর্মুহু তেজস্ক্রিয় রশ্মি আটকানোরও কোনও ক্ষমতা নেই এই গ্রহের। মানুষকে এখানে তার উপনিবেশ গড়তে সর্ব প্রথম এই তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিরুদ্ধেই লড়তে হতে পারে। |

সজয় পাল : গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করেছে নাসার নতুন মহাকাশযান ‘পাসিভিয়ারান্স’। এই নিয়ে মোট ৫ বার মঙ্গলের বুকে সফল অবতরণ করল পৃথিবী থেকে পাঠানো মহাকাশযান। এই অভিযানের চেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের পর থেকে। ততদিনে চাঁদে অর্থাৎ প্রথম পৃথিবীর বাইরের কোনও জ্যোতিষ্কে মানুষের ‘পদচিহ্ন’ অঙ্গিত হয়ে গিয়েছে। প্রায় তখন থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল মঙ্গলের বুকে অবতরণ করা।
কিন্তু চাঁদে পা রাখার প্রায় ৫০ বছর পরেও মঙ্গলে রোভার পাঠানো ছাড়া মানুষ সশরীরে নিজেকে পাঠাতে পারেনি। চেষ্টার ত্রুটি তবুও থেমে নেই। প্রায় প্রতি বছরই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানরা। তবে এখনও পর্যন্ত মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর মতো আশানুরূপ কোনও উপযুক্ত পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।
অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একদলের দাবি, খুব শীঘ্রই মঙ্গলের বুকে তাঁরা গড়ে তুলতে পারবেন মানুষের উপনিবেশ। কোনও একদিন হয়তো এটিও সম্ভব হবে। কারণ অসম্ভবকে সম্ভব করা মানুষের কাছে একেবারেই কঠিন কিছু নয়। তবে সে পথে এগোতে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ নিতে হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।
প্রথমত, মঙ্গলের চৌম্বকীয় স্তর অত্যন্ত দুর্বল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুদূর অতীতে কোনও এক বৃহদাকার উল্কাপিণ্ডের আঘাতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে মঙ্গলের এই চৌম্বক শক্তি। যার জন্য এই গ্রহে ‘ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট’ এর কোনও অস্তিত্ব নেই। এই বেল্টের অভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আগত মুহুর্মুহু তেজস্ক্রিয় রশ্মি আটকানোরও কোনও ক্ষমতা নেই এই গ্রহের। মানুষকে এখানে তার উপনিবেশ গড়তে সর্ব প্রথম এই তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিরুদ্ধেই লড়তে হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি ৯৫ শতাংশেরও বেশি এবং অক্সিজেনের পরিমাণ ১ শতাংশেরও অনেক কম। তাই এখানে বসবাসের জন্য পরিবেশের অক্সিজেনের উপর নির্ভর না করে কৃত্রিমভাবে অফুরন্ত অক্সিজেন প্রস্তুত করার ঝুঁকি অবশ্যই নিতে হবে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে স্বল্প সময়ে অক্সিজেন প্রস্তুত করার প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির আরও উন্নতিসাধন আশা করা যেতেই পারে।
তৃতীয়ত, মঙ্গলে কোনও এক সময়ে জলের উপস্থিতি অবশ্যই ছিল, এমন প্রমাণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। কিন্তু দুই মেরু ছাড়া মঙ্গলের আর কোথাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জলের প্রমাণ নেই। এই গ্রহে বসবাসের পূর্বে যথেষ্ট পরিমাণে জলের যোগান অবশ্যই করতে হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।
চতুর্থত, মঙ্গলে উপনিবেশ তৈরি করলেও পৃথিবীর সঙ্গে অতি শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন থাকবে সবসময়ই। কারণ মঙ্গলে উপনিবেশ তৈরি হলেও ভরকেন্দ্র অবশ্যই থাকবে পৃথিবীতে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র রেডিও সিগন্যালের উপর নির্ভর করলে চলবে না। এমনিতেই পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ২২ কোটি কিলোমিটার। অতি দ্রুতগতির যানে চেপে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেও সেখানে পৌঁছাতে কম করে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লেগে যাবে। এত দীর্ঘ সময়ে মহাশূন্যের মাইক্রোগ্রাভিটির জন্য অসুস্থ হয়ে পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। তার উপর বহু দূরের যাত্রাপথে এক সঙ্গে খুব বেশি রসদও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাতে খরচও অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যাবে।
যদিও মানুষের কাছে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলের বুকে মানুষের রাজত্ব চলবে না, এটা ভেবে নেওয়াও সম্পূর্ণ ভুল। এক পা দু’পা করে এগোতে এগোতে সমস্ত বাধা কাটিয়ে একদিন ঠিকই মানুষ পৌঁছে যাবে মঙ্গলের দুয়ারে, এটা ধরে নেওয়াই যেতে পারে।