আজও ভক্তদের মুখে মগদানন্দ গিরি র অলৌকিক শক্তির কথা শোনা যায়। বহুবার বিপদ থেকে তিনি ভক্তদের উদ্ধার করেছেন। মগদানন্দ গিরি বিভিন্ন ধর্মস্থানে পরিভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। একবার তিনি ভক্তদের কাছে বললেন, ত্রিবেণী সঙ্গম যাবেন। তাঁর কথমত আমোদপুর থেকে বাস ছাড়ল ত্রিবেণীর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে অপরূপ শোভা ও স্নিগ্ধতা মগদানন্দ গিরি কে মুগ্ধ করেছিল। তিনি এক ভক্তকে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর এখানেই যেন তাঁকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়।

সুজয় ঘোষাল ও বিশ্বজিৎ ঘোষ : বীরভূম জেলা হল পঞ্চ সতীপীঠের ভূমি। এই জেলাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক শৈবপীঠ ও শক্তিপীঠ বা কালীক্ষেত্র। বীরভূম জেলার আমোদপুর শহরেও রয়েছে এই রকমই এক অজানা কালীক্ষেত্র। স্থানীয়দের কাছে এই কালীক্ষেত্র মগনেশ্বরী কালীবাড়ি নামে পরিচিত। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানান ইতিহাস ও এক মহান সাধিকার কৃচ্ছসাধনের গল্প।
আমোদপুরের স্থানী বাসিন্দা প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় ওরফে প্রসূন চট্টোপাধ্যায়-এর থেকে জানা যায়, প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে বর্তমান আমোদপুর রেলস্টেশনের পূর্ব দিক ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সেই সময়ে সিদ্ধিলাভের উদ্দেশে কলকাতার বাগবাজার থেকে বীরভূমে আসেন মৃণালিনী দেবী। এই মৃণালিনী দেবীর জন্ম ১২৫২ বঙ্গাব্দের ৩১ বৈশাখ। ছোট থেকেই প্রচন্ড সংযমী চরিত্রের ছিলেন তিনি। মাত্র ৮ বছর বয়সে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে সাধনা করতে চলে যান। তিন বছর পর তাঁকে পরিবারের সদস্যরা খুঁজে পান। সেই সময় কৈলাসপতি নামে এক সাধক তাঁর পরিবারকে জানান, “এই মেয়ে একদিন বিখ্যাত সন্ন্যাসিনী হবে”। অনেক পরে তাঁর কথা সত্য বলে প্রমানিত হয়েছিল।
একবার আমোদপুর রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার মণি মিত্র স্বপ্ন দেখেন, এক মহিলা বিনা টিকিটে আমোদপুরে আসছেন। সেই স্বপ্ন অনুযায়ী, স্টেশনে এক মহিলাকে খুঁজেও পাওয়া যায়। তাঁর কাছে কোনও টিকিটও ছিল না। তাঁকে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দেখে কারণ জানতে চাইলে জানা যায়, তিনি যাবেন ডাবুক গ্রামে কৈলাসপতি বাবার কাছে। তাঁর কাছ থেকে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করবেন। অবশ্য দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন অনেক পরে। এর আগে মৃণালিনী দেবী রেলস্টেশন সংলগ্ন জঙ্গলে তপস্যা করতে থাকেন।
শোনা যায়, কিছুদিন পর একবার ডাবুক গ্রামে সাধক বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এরপর তাঁরা দুজনেই কৈলাসপতির কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষাগ্রহণ করার পর মৃণালিনী দেবীর সন্ন্যাস নাম হয় মগদানন্দ গিরি। আমোদপুর ফিরে তিনি ভক্তদের সাহায্যে দক্ষিণেশ্বর কালীর আদলে মগনেশ্বরীর শিলা মূর্তি স্থাপনা করেন। এবং পাকাপাকিভাবে আমোদপুরেই থাকতে শুরু করেন।

তাঁর সঙ্গে বামাক্ষ্যাপার ভালোই সখ্যতা ছিল। শোনা যায়, একবার তারাপীঠ মহাশ্মশানে কুকুরের সঙ্গে আহার করতে গিয়ে কুকুরের কামড়ে আহত হন বামদেব। সেই সময় সুদূর আমোদপুর থেকে তারাপীঠে বামদেবের সেবা করতে ছুটে যান মগদানন্দ গিরি।
আজও ভক্তদের মুখে মগদানন্দ গিরি র অলৌকিক শক্তির কথা শোনা যায়। বহুবার বিপদ থেকে তিনি ভক্তদের উদ্ধার করেছেন।
মগদানন্দ গিরি বিভিন্ন ধর্মস্থানে পরিভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। একবার তিনি ভক্তদের কাছে বললেন, ত্রিবেণী সঙ্গম যাবেন। তাঁর কথমত আমোদপুর থেকে বাস ছাড়ল ত্রিবেণীর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে অপরূপ শোভা ও স্নিগ্ধতা মগদানন্দ গিরি কে মুগ্ধ করেছিল। তিনি এক ভক্তকে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর এখানেই যেন তাঁকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়।
মগদানন্দ গিরি ১৩৪ বছর বেঁচেছিলেন। সেই সময় অমৃতবাজার পত্রিকায় সবচেয়ে প্রবীণ ভোটদাতা শিরোনামে তাঁর ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল। ভক্তদের কাছে তিনি ছিলেন ‘গুরুমা’। ভাল কাজের যেমন বিধান দিতেন, ঠিক তেমনি খারাপ কাজেও শাসন করতেন। ১৩৮৬ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, তাঁকে ত্রিবেণী সঙ্গমে সমাধিস্থ করা হয়।
মগদানন্দ গিরি র নামানুযায়ী আমোদপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন এই কালী মন্দিরটি বর্তমানে মগনেশ্বরী কালী মন্দির নামে পরিচিত। সূদর থেকে আসা এক সন্ন্যাসিনীর একক প্রচেষ্টা, ত্যাগ, নিষ্ঠা এই কালী মন্দিরটির ভিত গড়ে উঠেছে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে মন্দিরের মাহাত্ম্য থাকলেও সামগ্রিক বীরভূম জেলায় তেমনভাবে এখনও পরিচিতি গড়ে তুলতে পারেনি।