ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শকুন বিলুপ্তির কারণ ছিল ‘ডাইক্লোফেনাক’

Advertisement
ব্যথা কমাতে ব্যবহৃত এই ‘ডাইক্লোফেনাক’ মৃত্যুর পরেও থেকে যায় মৃত পশুর শরীরে। পরে শকুন ওই মরা পশুর মাংস খেলে তার শরীরেও প্রবেশ করে এই ‘ডাইক্লোফেনাক’। ‘ডাইক্লোফেনাক’ সরাসরি আক্রমণ করে শকুনের কিডনিতে। পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, পশুদের এই ব্যথা নাশক ওষুধটি শকুনের কিডনি বিকল করে ২-৩ দিনের মধ্যে মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। যা বর্তমানে শকুন নিশ্চিহ্নের সবচেয়ে বড়ো কারণ হিসাবে ধরা দিয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শকুন বিলুপ্তির কারণ ছিল ‘ডাইক্লোফেনাক’
Image by Free-Photos from Pixabay

অনলাইন পেপার : বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্যর বেশ প্রচলন রয়েছে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না’। অর্থাৎ যতক্ষণ দাঁত থাকবে, দাঁতের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় আসবে না। কিন্তু দাঁত না থাকলেই দাঁতের প্রয়োজন কতটুকু এটাই ভাবিয়ে তুলবে তাকে। বাংলার এই প্রবাদ বাক্যটি শকুন বিলুপ্তির বেলাতেও বেশ মানানসই। শকুনের ব্যাপক উপস্থিতিতে এদের উপকারিতা নিয়ে প্রায় কাউকেই বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। অথচ শকুন বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতেই এদের উপকারিতা নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়ে যায়।

একসময়ে পরিবেশে শকুনের ব্যাপক বিস্তার ছিল। তখন কদাকার এই পাখিটি মানেই ছিল কোনও এক অশুভ সংকেত। গল্প, উপন্যাস বা কবিতার ক্ষেত্রেও শকুনকে নেতিবাচক হিসাবে দেখানো হয়েছে বহুবার। যা থেকে শকুন সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকেই মানসকক্ষে তৈরি হয়েছে শুধুই আতঙ্ক।

অথচ গ্রাম বা শহরের প্রান্তে উপস্থিত ভাগাড়ে ফেলা দেওয়া এই মৃত পশুর শরীর ভক্ষণকারীদের উপকারিতা নিয়ে ততটা বিস্তর আলোচনা হত না তখন। দেখানো হত না মৃত পশুর শরীর খেয়ে কিভাবে শকুনেরা দিনের পর দিন পরিবেশকে রোগ ছড়িয়ে পড়া বা মহামারী তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করে চলেছে। পরে যখন শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে, তখন শকুন রক্ষার্থে এদের উপকারিতার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু হয়।

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে শকুনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটিরও বেশি। তবে সেই সংখ্যা অতি আশ্চর্যরকমভাবে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শুরু থেকে কমতে শুরু করে। যা ক্রমশ কমতে কমতে বর্তমানে মাত্র ১ লাখের নিচে নেমে এসেছে। যে সমস্ত অঞ্চলগুলিতে একসময়ে শকুনের প্রাধান্য ছিল অসম্ভবরকম, সেগুলি আজ প্রায় হয়ে গিয়েছে শকুন শূন্য। এমনকি গ্রাম বা শহরের প্রান্তে বিস্তৃত ভাগাড়গুলিও উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোথাও বা উঠেও গিয়েছে সম্পূর্ণভাবে।

প্রথম দিকে এই উধাও হয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও কারণ জানা ছিল না কারওরই। এবিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভ্রান্ত কয়েকটি ধারণা সামনে এনেছিলেন মাত্র। তবে সেগুলির উপর জোর দিয়ে শকুন বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছিলেন না প্রায় কেউই। পরিবেশের জলবায়ু পরিবর্তনকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল এক্ষেত্রে।

কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনকেই শকুন বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসাবে মানতে রাজী ছিলেন না। তাঁরা অন্য কারণগুলি খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক পরে ২০০৩ সাল নাগাদ ড. লিণ্ডেসে ওক এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করেন। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন-এর একজন গবেষক। তিনিই প্রথম হাতে কলমে প্রমাণ করেন শকুন বিলুপ্তির প্রধান কারণ ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের এক ধরণের পশুদের ব্যথা নাশক ওষুধ।

বিবিসি সংবাদ মাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এই ওষুধ ৯০-এর দশকে গৃহপালিত পশুদের ব্যথা কমাতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হত। এটি ছিল সেসময়ে খুবই সস্তা ও সহজলভ্য।

ব্যথা কমাতে ব্যবহৃত এই ‘ডাইক্লোফেনাক’ মৃত্যুর পরেও থেকে যায় মৃত পশুর শরীরে। পরে শকুন ওই মরা পশুর মাংস খেলে তার শরীরেও প্রবেশ করে এই ‘ডাইক্লোফেনাক’। ‘ডাইক্লোফেনাক’ সরাসরি আক্রমণ করে শকুনের কিডনিতে। পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, পশুদের এই ব্যথা নাশক ওষুধটি শকুনের কিডনি বিকল করে ২-৩ দিনের মধ্যে মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। যা বর্তমানে শকুন নিশ্চিহ্নের সবচেয়ে বড়ো কারণ হিসাবে ধরা দিয়েছে। ঘটনাটি জানার পরই ‘ডাইক্লোফেনাক’ নিসিদ্ধ হয়ে যায় ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে। এমনকি এর পাশাপাশি সমান কার্যকর ‘কিটোপ্রোফেন’-কেও নিসিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

তবে বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শকুনের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। শকুন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। সারা বিশ্বকে আরও সচেতন করতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতন দিবস’।

Advertisement
Previous article‘ভয়েস ক্লোনিং’ সফটওয়্যারের ব্যবহারে অপরাধীদের সুযোগ বাড়ছে না তো?
Next articleএ যেন আধুনিক কুম্ভকর্ণ, বছরের ১০ মাস ঘুমিয়ে কাটান তিনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here