Advertisement
দেবকুমার দত্ত : ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা’ গানটি লিখেছিলেন। রচনাকালের সঠিক তারিখ জানা যায়নি এবং এই গীতিকবিতাটির পাণ্ডুলিপিও এখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত।
লক্ষ্মৌর পণ্ডিত বিষণ নারায়ণ দার-এর সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশনের (২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর, ১৯১১) দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর ১৯১১, বুধবার (১১ই পৌষ, ১৩১৮) দুপুর বারোটায় অধিবেশনের শুরুতে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ প্রথম গীত হয়। পরের দিন ২৮ ডিসেম্বর ১৯১১ ‘দ্য বেঙ্গলী’ নামে ইংরেজি দৈনিকে এই গানটির সম্পূর্ণ অর্থাৎ পাঁচটি স্তবকের ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। আজও জানা যায়নি কে বা কারা এই অনুবাদ করেছিলেন।
২৮ ডিসেম্বর ১৯১১ ‘দ্য বেঙ্গলী’ এটিকে ‘a patriotic song’ অর্থাৎ একটি দেশাত্মবোধক গান বললেও ওই দিনই ‘দি ইংলিশম্যান’ লিখল : ‘a song of welcome to the King Emperor specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore’ অর্থাৎ বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা মহারাজের আগমন উপলক্ষে বিশেষভাবে রচিত একটি গান। সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার’ প্রেরিত সংবাদে ইংল্যান্ডের সাপ্তাহিক ‘ইণ্ডিয়া’-তে ছাপা হল : ‘a Bengali song specially composed in honour of the royal visit was sung’ অর্থাৎ রাজকীয় ভ্রমণের সম্মানে বিশেষভাবে রচিত একটি বাংলা গান গীত হল। এ সবই ভ্রান্তিবিলাস, ‘a bit of false news’ বা একটুকরো মিথ্যা সংবাদ। তবু তা ইতিহাসকে বিকৃত করল। রবীন্দ্রনাথ এই ‘নিঃসীম নির্বুদ্ধিতা’র কোনও সদুত্তর দেওয়ার আবশ্যকতা মনে করেননি।
রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ১৯১২ সালে ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকায় এই গানটি ‘ভারত-বিধাতা’ শিরোনামে ছাপানো হয়। অতিরিক্ত পরিচয় দিতে লেখা হয় : ‘ব্রাহ্মসঙ্গীত’। ১৯১২ সালের ২৫ জানুয়ারি মহর্ষি ভবনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক মাঘোৎসবে এই সঙ্গীতটি রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় গীত হয়। ১৯১৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ৩২তম অধিবেশনের (২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর) শেষ দিনে ‘জনগনমন’ গানটি গীত হয়। কৌতুকের বিষয়, ‘দি ইংলিশম্যান’ ও ‘রয়টার’ এবার উভয়েই ‘জনগনমন’কে জাতীয়তাবোধক সঙ্গীত হিসাবে বর্ণনা করল।
রবীন্দ্রনাথ এই গানটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯১৯, ২৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ অন্ধ্রপ্রদেশের চিতোর জেলার মদনপল্লিতে অবস্থিত বেসান্ত থিওসফিক্যাল্ কলেজের অধ্যক্ষ ড. জেমস্ এইচ্ কাজিনস্-এর অনুরোধে বাংলায় গেয়ে শোনান। সেই সময় ড. কাজিনস্-এর অনুরোধে ‘The Morning Song of India’ শিরোনামে সমগ্র গানটি রবীন্দ্রনাথ ইংরাজিতে অনুবাদ করেন এবং ড. কাজিনস্-এর স্ত্রী মার্গারেট কাজিনস্-এর সহযোগিতায় ইংরেজি অনুবাদটির স্বরলিপি তৈরি করলেন। রবীন্দ্রনাথের সেই পাণ্ডুলিপি ওই কলেজের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। আজও ওই কলেজের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে এটি স্বীকৃত।
বুধবার, ২৮ জুলাই ১৯২০ ইংল্যান্ডের উইগমোর হল ও ২৭ অক্টোবর ১৯২৬ হাঙ্গেরির বুদাপেস্ত শহরের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ‘জনগনমন…’ আবৃত্তি করে শোনান।
রবীন্দ্রনাথ ‘পঞ্জাব’ ও ‘মরাঠা’ লিখলেও অনেকেই এঁদের বিকৃতি ঘটিয়ে ‘পাঞ্জাব’ ও ‘মারাঠা’ উচ্চারণ করেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন দিলীপকুমার রায়কে ১০ নভেম্বর, ১৯২৯ : “তার পরে যাঁরা শোধন করেছেন তাঁরাই নিরাকারকে সাকার করে তুলেছেন, আমার চোখে পড়েনি”। অর্থাৎ আমরা ভুলবশত ‘পঞ্জাব’ আর ‘মরাঠা’-র পরিবর্তে ‘পাঞ্জাব’ ও ‘মারাঠা’ সোৎসাহে এখনও গেয়ে চলি। অন্য একটি পত্রে তিনি দিলীপকুমার রায়কে ১৯৩১, সেপ্টেম্বর মাসে লিখছেন : “ ‘জনগনমন-অধিনায়ক’ সংস্কৃত ছন্দে বাংলায় আমদানি। … সকল প্রদেশের কাছে যথাসম্ভব সুগম করার জন্যে যথাসাধ্য সংস্কৃত শব্দ লাগিয়ে ওটাকে আমাদের পাড়া থেকে জয়দেবীয় পল্লীতে চালান করে দেওয়া হয়েছে”। আমরা বুঝতে পারি, সহজভাবেই কবিবর জয়দেব গোস্বামী – বিরচিত শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্-এর কাছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ রচনার ক্ষেত্রে তাঁর ঋণ স্বীকার করে নিয়েছেন।
Advertisement