বাঁদনা বা সহরায় পরব : সাঁওতালরা যেভাবে পালন করেন ৫ দিনের এই বড়ো উৎসব

Advertisement

সহরায় পরব-এর শুভারম্ভের দিন অর্থাৎ ‘উম মাহা’-তে বাড়ির মহিলারা নিজেদের ঘর-বাড়ির মেঝে থেকে আরম্ভ করে উঠোন ও আশেপাশের সমস্ত জায়গা ভালো করে গোবর দিয়ে লেপে দেন। নিজেদের বাড়িগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে ও রাঙিয়ে তোলেন। তারপর তাদের বাড়ির যে সমস্ত পুরনো বস্ত্র আছে সেগুলি ভালো করে পরিষ্কার করেন। সাঁওতাল মহিলারা নিজেদের মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত ভালোভাবে পরিষ্কার করেন।


বাঁদনা বা সহরায় পরব : সাঁওতালরা যেভাবে পালন করেন ৫ দিনের এই বড়ো উৎসব

সুভাষ চন্দ্র মুরমু : সহরায় পরব বা বাঁদনা প্রধানত পৌষ মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হয়। আর তা চলে পাঁচদিন ধরে। পাঁচদিন ব্যাপী দৈনন্দিন পূজাকর্মের মধ্যে দিয়ে এই উৎসবটি পালিত হয়। এটি সাঁওতাল উপজাতির একটি প্রধান উৎসব। এই উৎসব বা পরব শুরু হওয়ার আগে বাড়ির কন্যা, যাদের বিবাহ হয়ে গেছে তাদের নিমন্ত্রণ করতে হয়। এই নিমন্ত্রণে বাপের বাড়ির থেকে কেউ না এলে বিবাহিত মহিলারা দুঃখ পান। তাই বছরের অন্য সময়ে কোনও কারণ বশত বিবাহিত মহিলাদের বাড়ি না গেলেও এই পরবে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া আবশ্যক। উৎসবের প্রথম দিনকে বলে ‘উম মাহা’ অর্থাৎ শুভ সূচনা। দ্বিতীয় দিন হল ‘বঙ্গান মাহা’, তৃতীয় দিন ‘খুন্টৌ’, চতুর্থ দিন ‘জালে মাহা’ ও পঞ্চম দিনকে বলা হয় ‘সাকরাত মাহা’।

সহরায় পরব-এর শুভারম্ভের দিন অর্থাৎ ‘উম মাহা’-তে বাড়ির মহিলারা নিজেদের ঘর-বাড়ির মেঝে থেকে আরম্ভ করে উঠোন ও আশেপাশের সমস্ত জায়গা ভালো করে গোবর দিয়ে লেপে দেন। নিজেদের বাড়িগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে ও রাঙিয়ে তোলেন। তারপর তাদের বাড়ির যে সমস্ত পুরনো বস্ত্র আছে সেগুলি ভালো করে পরিষ্কার করেন। সাঁওতাল মহিলারা নিজেদের মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত ভালোভাবে পরিষ্কার করেন। এদিন গ্রামের পাঁচজনের একজনকে ‘গড়েত’ করা হয়। তিনি প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে পুজোর সামগ্রী অর্থাৎ মুরগি, চাল, তেল, লঙ্কা, হলুদ ও লবণ আদায় করেন। এখানে আদায় করা মুরগি স্বয়ং গড়েত-কেই ধরতে হয়। যদিও গড়েত পাড়ার ছেলেদের সাহায্য নিয়ে মুরগি ধরেন।

তারপর পাড়ার পাঁচজন তাদের পুজোর সামগ্রী নিয়ে পুজোর উদ্দেশ্যে রওনা হন। সাধারণত মাঠেই পুজো হয়ে থাকে। পুজোর পুরোহিত হিসাবে কাজ করেন ‘নাইকে বাবা’। তাকে সাহায্য করার জন্যে অবশ্য অন্যেরাও থাকেন। পুজো হয়ে যাওয়ার পর খিচুড়ি বা সুড়ৌ তৈরি হয়। এটাই পুজোর প্রসাদ। পুজোর শেষে প্রসাদ গ্রহণের পর সবাই বাড়ি ফিরে আসেন। গ্রামে পৌঁছে প্রথমে ‘মাঁঝহি’ স্থানে পুজো করতে ‘মাঁঝাহি বাবা’-র কাছে যেতে হয়। এই সময় মাঁঝহি বাবা সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও ‘গাই জাগাও’ গান করেন। এছাড়াও এদিন নাইকে বাবা মাঠের মধ্যে একটি ডিম রেখে আসেন। সেই ডিমের দিকে গরুর পাল নিয়ে যাওয়া হয়। যার বাড়ির গরু সেই ডিম ছাটবে তাদের বাড়ি হবে মঙ্গলময়।

দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ‘বঙ্গান’। এদিন প্রতিটি পরিবার নিজের বাড়িতে থাকার চেষ্টা করে। পরে নিমন্ত্রিত অতিথিরা বাড়িতে আসতে শুরু করেন। এক কথায় বঙ্গান কঠোর নিয়ম মেনে পরিচালিত হয়।

তৃতীয় দিন হল ‘খুন্টৌ’। বাড়ির মহিলারা প্রায় সকাল থেকেই নিজেদের সাজিয়ে তোলেন বিভিন্ন অলংকারে। তারপর বাড়ির সীমানার মধ্যে কুলহিতে আলপনা আঁকেন। আলপনা আঁকার জায়গাটি আগে থেকেই গোবর দিয়ে লেপে পরিষ্কার করা হয়। এবার সেখানে পোঁতা হয় একটি শক্ত খুঁটি। এরপর ওই খুঁটিতে নিজেদের পোষা গরুগুলিকে পিঠে, পুলি, ধানের শিষ দিয়ে সাজিয়ে বেঁধে দেন। পাড়ার প্রত্যেক মহিলা ওই গরুগুলিকে প্রণাম করেন। পরে পাড়ার পুরুষেরা ও জামাতারা গরুর গলায় বাঁধা পিঠে-পুলি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কথিত আছে, এটি একটি মহাপ্রসাদ। পিঠে-পুলি ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গান-বাজনাও চলতে থাকে। তাতে গরুগুলিরও ভয় পেয়ে ছটফটানি বেড়ে যায়। তা সত্ত্বেও পিঠে-পুলি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলতেই থাকে। এই জনপ্রিয় দৃশ্য দেখতে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে যায় সেখানে।

জালি বা ‘জালে মাহা’ পরবের চুতুর্থ দিন। এদিন ‘ভালো-মন্দ’ খাওয়ার দিন। সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করেন বাড়ির মানুষজন ও আত্মীয়দের আমিষ খাওয়ানোর। এদিন পুরুষেরা সঙ বা বহুরপী সেজে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে চাল-ডাল আদায় করেন। এরও একটি বিশেষ গান রয়েছে। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, পরবের প্রত্যেক দিনই কিন্তু পুজোর ব্যবস্থা থাকে। আবার প্রতিদিনের গানও হয় আলাদা। বিকেল থেকেই শুরু হয় সেই গান-বাজনা।

সহরায় পরবের শেষ দিন হল ‘সাকরাত মাহা’। নাইকে বাবা একটি বড়ো ধরনের পিঠে বানিয়ে মাঠের নির্জন স্থানে একটি খুঁটিতে আটকিয়ে রাখেন। তারপর গ্রামের সমস্ত পুরষ তীর-ধনুক দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সেই পিঠেকে লক্ষ্যভেদ করতে চান। যিনি লক্ষ্যভেদে সফল হন, তাঁকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে আসা হয় গ্রামে এবং সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও এদিন নানারকম ক্রীড়া (শারীরিক কসরত)-রও আয়োজন থাকে। এদিন আবার বনে শিকারে যাওয়ার রীতিও রয়েছে।

Advertisement
Previous articleখেজুর রস কাঁচা খাচ্ছেন, ‘নিপাহ’ থেকে সাবধান থাকছেন তো?
Next articleকরোনা : ডবল ডোজের পরও আক্রান্ত হচ্ছে ভাইরাসে, কিন্তু কেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here