Advertisement
সজয় পাল : সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলার বারো মাস বহু যুগ আগে থেকেই প্রচলিত। প্রত্যেকটা মাস বা প্রত্যেকটা ঋতুর একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা আছে। মাস বা ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন উৎসব বা অনুষ্ঠানগুলিও পালিত হয়। বঙ্গে ইংরেজি ক্যালেন্ডার প্রচলন হওয়ার আগে বাংলা পঞ্জিকা-ই ছিল সর্বগ্রাহী।
১লা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রথম উৎসব। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্র–সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বিগত বছরের চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিনই নতুন বছরের প্রথম দিন হিসাবে ১লা বৈশাখ গৃহীত। দিনটি আপামর বাঙালি সমাজ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মিষ্টান্ন ভোজনের মাধ্যমে পালন করে। বাঙালি অধুরসিতপশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসাবেও গৃহীত।
এখন যেমন ১লা বৈশাখ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসব, সে যুগে এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা ১লা বৈশাখ ‘আর্তব উৎসব’ অর্থাৎ ঋতুধর্মী উৎসব হিসাবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার আগে পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করে থাকতে হত।
দেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সারা দেশ ব্যাপী হিজরী পঞ্জিকা চালু হয়। সেই পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করা হত। কিন্তু হিজরী পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় বঙ্গদেশে কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে খাজনা পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতায় কৃষকরা খুব মুশকিলে পড়ত।
এই সমস্যা সমাধান করতে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় এক নতুন সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রাচীন বর্ষপঞ্জিকায় সংস্কার আনার আদেশ দেন। সেই আদেশানুসারে বঙ্গদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফতেহউল্লা সিরাজি সৌর ও হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে বাংলায় নতুন এক প্রকার সনের নিয়ম তৈরি করেন। এই পদ্ধতিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয় ১৫৮৪ খৃস্টাব্দ থেকে। প্রথমে এই নতুন সনের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে প্রচলন হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)
নতুন বর্ষ পঞ্জিকা চালু হওয়ার পর খাজনা পরিশোধ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসে। বঙ্গের সমস্ত কৃষকদের সেসময়ে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সমস্ত রকমের খাজনা, শুল্ক বা মাশুল শোধ করতে হত। পরিশোধ করার পরের দিনই আপামর বাঙালি উন্মুক্ত হৃদয়ে উৎসবে মেতে উঠত। তারা একে অপরকে মিষ্টান্ন বিতরণ করে স্বাগত জানাত। ব্যবসায়ীরা তৈরি করত ‘হালখাতা’। এখানে হালখাতা বলতে নতুন হিসাবের বইকে বোঝানো হয়েছে। যা আজও বাঙালি সমাজে প্রচলিত। বিগত বছরের সমস্ত হিসাব, সমস্ত ধার-দেনা পরিশোধ করে নতুন বছরের শুরুতে নতুন হিসাবের খাতা মঙ্গল চিহ্ন ‘স্বস্তিক’ এঁকে উন্মোচন করা হয়। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিতে মঙ্গলদাত্রী লক্ষ্মী এবং সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো করা হয়। স্বাগত জানানো হয় সমস্ত ব্যবসায়ী সহযোগীদের।
কিন্তু এবছর কেমন যেন সব ওলটপালট হয়ে গেল। করোনা সংক্রমণ কেড়ে নিল বাঙালির চেনা ১লা বৈশাখের সমস্ত হিসাব-নিকাশ। কেউ বা নতুন বাংলা বছরের ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। কেউ বা হালখাতার নিমন্ত্রণপত্রও বিলিয়ে দিয়েছেন দু-একটি। কিন্তু লকডাউন ৩০ এপ্রিল (১৭ বৈশাখ ১৪২৭) পর্যন্ত দীর্ঘ হওয়ায় নতুন বছরের শুরুতে হালখাতার হাল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা সংক্রমণ ভারতে প্রবেশ করার পর ২৩ মার্চ থেকে ‘লকডাউন’ শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। প্রথমে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এর মেয়াদ থাকলেও পরে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাই ওই তারিখ পর্যন্ত এক প্রকার গৃহবন্দি থাকতে হবে সমস্ত দেশবাসীকে। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সমস্ত প্রতিষ্ঠান মূলত বন্ধ থাকবে এই ক’দিন। তাই মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে ব্যবসায়ীরা স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে হালখাতা।
শুধু মাত্র ব্যবসায়ীরাই এই দিনটি আনন্দের সঙ্গে পালন করে তা নয়, বঙ্গদেশের সমস্ত বাঙালিদের মনে প্রাণে এই দিনটি অন্য এক মাত্রা নিয়ে আসে। শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম্য অঞ্চলের উপকণ্ঠেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহযোগে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়।
দিনটি বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত আনন্দের। সে দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সহযোগিতায় এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করা হয় শহরের একাধিক রাস্তায়। নাচে-গানে মেতে ওঠে সমস্ত দিনই। এবছর তার কিছুই হবে না। করোনা সংক্রমণ এখানেও থাবা বসিয়েছে গভীরভাবে।
Advertisement