“ফিমেল” শুধু গল্প নয়, এ যেন এক জীবনের কথা

Advertisement
New3
বিজয় ঘোষাল : গ্রাম বাংলা যারা যাত্রাপালা দেখেছেন, তাদের কাছে ফিমেল শব্দটি খুব বেশি অপরিচিত নয়। একটা সময়ে যাত্রাপালায় অভিনয়ের জন্য নারীরা তেমনভাবে অংশগ্রহণ করত না। তখন নারী চরিত্রের শূন্যস্থান পূরণ করতে পুরুষরাই এগিয়ে আসত। এক শ্রেণীর পুরুষ ছিলেন, যারা শুধুমাত্র নারী চরিত্রেই অভিনয় করত।
     যদিও বর্তমানে অভিনয়ের জগত অনেকটাই পালটে গিয়েছে। যাত্রাপালা, নাটক, থিয়েটার, বা সিনেমা সবক্ষেত্রেই পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরা অভিনয় করে চলেছে। চলচ্চিত্রের নায়িকাদের সমাজ এখন যথেষ্ট সম্মান বা মূল্য দিচ্ছে।
     এই সম্মান যাত্রাপালার প্রথম যুগে একদমই ছিল না। বরং যাত্রাপালায় অভিনয় করা সংখ্যা লঘিষ্ঠ নারীরা ছিলেন সমাজের চোখে ‘ঘৃণ্য বস্তু’ বা অপাংতেয়। তা সত্ত্বেও তারা তাদের রূপ-রস ও যৌবনের বিনিময়ে হয়ে উঠত বাবুদের কাম ও বাসনার নিবৃত্ত সঙ্গী। সমাজে তারাই পরিচিত ছিল ‘ফিমেল’ নামে। অন্য কথায় এরাই ছিল বেশ্যাতাই সে যুগে ফিমেল’ বললে ওই অভিনেত্রীদের এক কথায় বোঝানো হত, সে কোনও যাত্রাদলে পুরুষদের কাছে বিক্রিত হওয়া ভোগ্যপণ্য
     সম্প্রতি বইমেলায় দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা লেখক অর্ঘ্য ঘোষের নতুন উপন্যাস ফিমেল”। যা আদতে ফিমেলদের জীবনের সুখ-দুঃখের এক বাস্তব পরিণতির চিত্রায়ন। উপন্যাসের মূল চরিত্র সোহাগী এখানে সোহাগী একজন গ্রাম্য বালিকা। বাবা-মা ও দিদি আদরীকে নিয়ে দিব্যি ছিল তাদের সুখের সংসার। সোহাগীর বাবাকে দেওয়া মিথ্যা চোর অপবাদ, মায়ের অপমৃত্যু, তারপর বাবার আবার নতুন বিয়ে এসবই এই উপন্যাসের এক-একটি জীবন্ত পর্ব
     বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পরই সংসারে নেমে আসে অশান্তি। সৎ মায়ের মিথ্যা ভালবাসা বুঝতে না পেরে দু বোনের জীবন ক্রমশ হয়ে ওঠে অভিশপ্ত। তাদেরজীবন থেকে হারিয়ে যায় স্কুলবেলা, বাল্যপ্রেম। আদরী বিক্রি হয়ে যায় কলকাতার পতিতাপল্লীতে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চলে যৌন অত্যাচার। তা সহ্য করতে না পেরে সে বাধ্য হয় গলায় দড়ি নিতে
new2
অর্ঘ্য ঘোষ
     এদিকে সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য সোহাগী অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাম লেখাই যাত্রাদলেছেড়ে চলে আসে ছেলেবেলার প্রথম প্রেম সায়নকে। এইযাত্রাদলে শুরু হয় সোহাগী জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। যাত্রাদলে থাকা অবস্থাতেইপ্রথমে অরূপ ও পরে সুনীলে সঙ্গে বিয়ে ও নিজের শরীর ও মনের সবটুকু দিয়ে তাদের কাছে ঠকে যাওয়া অংশগুলি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক অর্ঘ্য ঘোষ
     এর পরেও চলে সোহাগীর জীবন যুদ্ধ। যাত্রাপালার ‘ফিমেল তকমায় সে পরিণত হয় শহুরে ‘বাবু’দের ভোগ্যপণ্যে। তারপরেও যুদ্ধ থেমে থাকেনি। সে নিজেই প্রতিষ্ঠা করে নতুন যাত্রাদল। ভাত-কাপড়ের সন্ধান দেয় বহু মানুষের।
     এরপর বার্ধক্য। এও আর এক লড়াই। যৌবনের রঙ ফিকে হওয়ার পর তাকে বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয় ‘ফিমেল’ ভূমিকা। তবুও থেমে থাকেনি সে। যাত্রাদলের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ও যাত্রাদলের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাকে লড়তে হয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। অবশেষে ধরা পড়ে মারণ রোগ ‘এইডস’। যা তাকে সমাজ ও প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রায় অচ্ছুৎ করে তোলে।
     এখানেই শেষ নয়, এর পরেও আছে গল্প। শেষ পরিণতি কী হয়েছিল সোহাগীর? তা জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে অর্ঘ্য ঘোষের এই উপন্যাস ফিমেলএ যেন কোনও গল্প নয়, সমাজের এক বাস্তবতা। সমাজের কতটুকুই বা সমাজের মানুষ জানে। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখবেন সাংবাদিক ও লেখক অর্ঘ্য ঘোষ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমাজের এই প্রান্তিক চরিত্রগুলির আবিষ্কার ও তাদের ভাবনা যেভাবে তিনি “ফিমেল”-এ তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অনবদ্য।
Advertisement
Previous articleতারাশঙ্করের সেই ‘হাঁসুলী বাঁক’-এ আজ যেন ক্ষয় ধরেছে (ভিডিও সহ)
Next articleশ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্ ও স্বামী বিবেকানন্দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here