ইটণ্ডা-র জোড়বাংলা মন্দিরের মূল আকর্ষণ সম্মুখভাগের চোখ ধাঁধানো প্রাচীন টেরাকোটা র অপূর্ব কারুকার্য। শিল্পীরা তাঁদের নিপুণ হাতে অসম্ভব ধৈর্য ও সুচারু মানসিকতায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পুরাণের বিভিন্ন চিত্রপট তুলে ধরেছেন এখানে। এই মন্দিরের টেরাকোটা-তে রামায়ণ-মহাভারত সহ পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্য আশ্চর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এছাড়াও অত্যন্ত আশ্চর্যরকমভাবে ইউরোপিয়ান ভাবধারার একাধিক চিত্র এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সজয় পাল : বীরভূম জেলার ইটণ্ডা যে খুব পুরনো একটি গ্রাম তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অজয় নদের তীরবর্তী এই গ্রামটির অবস্থান বোলপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নীল ব্যবসায়ী জন চিপ এখানে একটি নীল কুঠিও নির্মাণ করেছিলেন। সেই সময় এই এলাকায় বেশ ভালোভাবেই নীল চাষ করা হত। আজও মাঝে মধ্যে নদী তীরবর্তী চাষের জমিগুলিতে দু-একটি নীলের গাছ মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় সেকথা।
যদিও চিপ সাহেবের সেই কুঠির কোনও অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে বেশ কয়েকটি টেরাকোটা মন্দির রয়েছে এখানে। যা ইটণ্ডা গ্রামের বিশেষ পরিচয় বহন করে চলেছে আজও। মন্দিরগুলি বিভিন্ন সময়ে নির্মাণ হয়েছে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। তাদের শরীর অলংকৃত করা হয়েছে পোড়ামাটির প্রাচীন টেরাকোটা-র বিভিন্ন ফলকে। যার কোনও কোনওটি ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গিয়েছে অথবা নষ্ট হওয়ার পথে। আবার কোনও কোনওটি সংস্কারের হাত ধরে টিকে রয়েছে এখনও।

ইটণ্ডা-র যা কিছু খ্যাতি, তা এখন প্রায় জোড়বাংলা কালী মন্দিরের জন্যই। এক সময় গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে তাদের কুঁড়ে ঘরের আদলে মন্দির নির্মাণ করা হত। এই সমস্ত মন্দিরগুলি সাধারণত চালা মন্দির নামেই বেশি পরিচিত ছিল। যখন দুটি চালা মন্দিরকে পাশাপাশি রেখে জোড়ায় নির্মাণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জোড়বাংলা মন্দির। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, এই রকম জোড়বাংলা মন্দির সমগ্র বীরভূম জেলায় মাত্র একটি-ই রয়েছে। আর সমগ্র বঙ্গদেশে রয়েছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই রকম প্রাচীন মন্দিরের গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়।
ইটণ্ডা-র এই মন্দিরের মূল আকর্ষণ সম্মুখভাগের চোখ ধাঁধানো প্রাচীন টেরাকোটা-র অপূর্ব কারুকার্য। শিল্পীরা তাঁদের নিপুণ হাতে অসম্ভব ধৈর্য ও সুচারু মানসিকতায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পুরাণের বিভিন্ন চিত্রপট তুলে ধরেছেন এখানে। এই মন্দিরের টেরাকোটা-তে রামায়ণ-মহাভারত সহ পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্য আশ্চর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এছাড়াও অত্যন্ত আশ্চর্যরকমভাবে ইউরোপিয়ান ভাবধারার একাধিক চিত্র এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তবে মন্দিরের নির্মাণকাল ও নির্মাতা সম্পর্কে বেশ বিতর্ক রয়েছে এখানে। কেউ বলেন আঠারোশো শতকের প্রথমদিকে রুহিদাস সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল। রুহিদাস সম্প্রদায়ের মানুষদের সেসময় পেশা ছিল মরা পশুর হাড় কেটে চিরুনি, গলার মালা সহ বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরি করা। তারা আঠারোশো শতকের প্রথম দিকে টেরাকোটা সমৃদ্ধ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল সোনামুখীর শিল্পীদের এনে।
আবার অনেকেই দাবি করেন, দুর্ধর্ষ হাড়কাটা ডাকাতদল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল তাদের তন্ত্র সাধনার জন্য। তারা মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল ১৮৪৪ সাল নাগাদ। অনেক পরে মন্দিরের মালিকানা সত্ত্ব চলে যায় গ্রামের জমিদারদের হাতে।

জোড়বাংলা মন্দিরের অদূরে গ্রামের অন্দরে রয়েছে আরও দুটি প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির। তারই একটি ১৮১৮ সাল নাগাদ নির্মাণ করেছিলেন রাসানন্দ সাধু। কিছুটা ওপরে মন্দির গাত্রের একটি কালো ফলকে সেই নির্মাণ সাল ও নির্মাতার নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। মন্দিরটিকে রাসেশ্বর শিব মন্দির বলা হয়ে থাকে। মন্দিরটির চূড়া পাঁচটি হওয়ার কারণে অনেকে আবার এই মন্দিরকে পঞ্চচূড়া শিব মন্দিরও বলেন। এখানে সমগ্র মন্দিরের শরীর জুড়ে অলংকরণ করা রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটা-র অপূর্ব কারুকার্যে। তবে সংস্কারের অভাবে আজ তার অনেক অংশই নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে।
রাসেশ্বর শিব মন্দিরের পাশেই রয়েছে আরও একটি প্রাচীন শিব মন্দির। ১৮১৫ সাল নাগাদ দেউল প্রকৃতির এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন গদাধর পাইন। ২০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরটি নবীন বলেই মনে হতে পারে। কারণ সম্প্রতি বেশ ভালোভাবেই সংস্কার করা হয়েছে এই মন্দিরটির আপাদমস্তক। মন্দিরটির সামনের দিকের কিছুটা অংশ জুড়েই শুধুমাত্র প্রাচীন টেরাকোটার ছাপ নজরে পড়ে। এখানেও বিভিন্ন পৌরাণিক চিত্র রয়েছে টেরাকোটার প্রতিটি ফলকে।