অসম্ভব বিনয়ী স্নেহপ্রবণ এই গুণী মাটির মানুষটির ভালোবাসার সান্নিধ্যে অনেকটা সময় কাটানো গেল। যা আমার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। কথায় কথায় উঠল সিনেমার বিষয়টি। ইন্দিরা ঠাকুরুন-এর ভূমিকায় চুনিবালা দেবী যে অসামান্য অভিনয় করে গেছেন, সেই চরিত্রকে বর্তমান সময়ে ফুটিয়ে তোলা একরকম দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু হরকুমারদা সেই চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করেছেন। পুরুষ হয়েও একজন বৃদ্ধা নারীর চরিত্রে অভিনয় করার দুঃসাহস এই যুগে হরকুমারদার মতো গুণী শিল্পীরাই দেখাতে পারেন।

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : উপরের ছবিটি চেনা যাচ্ছে? ‘হ্যাঁ চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছিনা’ তাইতো! তাহলে বলি, গত ১০ নভেম্বর বুধবার আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দ প্লাসের পাতায় ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল। বিখ্যাত বামপন্থী চলচ্চিত্র পরিচালক অনিক দত্তের পরিচালনায় সত্যজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় নিবেদিত চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’ ছবির সংবাদ সূত্রে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল।
সম্প্রতি পরিচালক অনীক দত্ত শুরু করেছেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবি নির্মাণের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে এক চলচ্চিত্র নির্মাণের। বোলপুরে সেই ছবির একপ্রস্থ শুটিংও হয়ে গেছে। এই ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় কাজ করার কথা ছিল অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু তাঁর ডেট নিয়ে কিছু সমস্যা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত চরিত্রটি করছেন ছোটপর্দার শিল্পী জিতু কামাল। সত্যজিতের লুকে তাকে অসাধারণ মানিয়েছে।
ছবির প্রতিটি চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অনীকদা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন সত্যজিতের ছবিকে অনুসরণ করার। এক্ষেত্রে ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত কঠিন একটি চরিত্র রয়েছে, সেটি হল চুনীবালা দেবী অভিনীত ইন্দিরা ঠাকুরুনের চরিত্র। সত্যজিতের ছবিতে যার ভূমিকা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এমন সময় এইরকম একটি চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। যাইহোক, বিশিষ্ট নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যে অনীক খুঁজে পেয়েছেন সেই বিরল চরিত্রটিকে। তিনি হলেন আমাদের চির পরিচিত বীরভূমের গৌরব বাংলার লেটো গানের বিশিষ্ট লোকো শিল্পী হরকুমার গুপ্তের মধ্যে। আমরা জানি আমাদের প্রিয় হরদা এই বৃদ্ধ বয়সেও বাংলার গ্রামগঞ্জ মাতিয়ে তোলেন তার লেটো গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে।

অতিসম্প্রতি একরকম আকস্মিকভাবেই তাঁর বাড়িতে হাজির হয়েছিলুম। অসম্ভব বিনয়ী স্নেহপ্রবণ এই গুণী মাটির মানুষটির ভালোবাসার সান্নিধ্যে অনেকটা সময় কাটানো গেল। যা আমার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। কথায় কথায় উঠল সিনেমার বিষয়টি। ইন্দিরা ঠাকুরুন-এর ভূমিকায় চুনিবালা দেবী যে অসামান্য অভিনয় করে গেছেন, সেই চরিত্রকে বর্তমান সময়ে ফুটিয়ে তোলা একরকম দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু হরকুমারদা সেই চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করেছেন। পুরুষ হয়েও একজন বৃদ্ধা নারীর চরিত্রে অভিনয় করার দুঃসাহস এই যুগে হরকুমারদার মতো গুণী শিল্পীরাই দেখাতে পারেন। আনন্দবাজারে প্রকাশিত ছবি থেকে হরকুমারদাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে ইনি ইন্দিরা ঠাকুরুন নন পুরুষ হরকুমার গুপ্ত। লেটো গানের এই বিশিষ্ট শিল্পী নাট্য আকাদেমি সহ নানা ছোট-বড় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী সহ নানা প্রতিষ্ঠানের নাট্য বিভাগে ওয়াকসপ পরিচালনা করেছেন নানা সময়ে।
আক্ষেপ হয় সহজ-সরল এই প্রান্তিক মানুষটিকে আমরা কতটুকু সম্মান জানাতে পেরেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ফেসবুকের পাতায় বড় বড় আস্ফালন করি। তারা হয়তো একবারও ভাবে না আমাদের এই বীরভূমের রাঙ্গামাটিতে কত অসংখ্য নক্ষত্র আজও আমাদের আলোক বৃত্তের বাইরে থেকে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। হরদাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। না তাঁর ছবিতে অভিনয়ের কৃতিত্বের জন্য নয়। তিনি যে সামগ্রিকভাবে লেটো গানকে জনপ্রিয় করার কাজে সারা জীবন প্রাণপাত পরিশ্রম করলেন, ঠিক দুখু মিয়ার (নজরুল ইসলাম) মতোই সেই মহান কাজের জন্য।
তাঁর কাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আরেকদিন হবে। আপাতত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি ‘অপরাজিত’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায়। সেখানে হয়তো হরদাকে আমরা আবার নতুন রূপে আবিষ্কার করব।