‘দ্বারে আসি দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’ : রবীন্দ্র-জয়ন্তী ও কিছু কথা

Advertisement
25
অতনু কুমার সিংহ : বাংলা চিরকালই কবির দেশ। জয়দেব, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, কৃত্তিবাস, কাশীরাম, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, মধুসূদনের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী হয়ে এই বাংলাতেই জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। বাংলা মতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দে ২৫ বৈশাখ, সোমবার (বাংলা পঞ্জিকা মতে ভোর টার আগে পূর্বদিন)ইংরেজি মতে (রাত ১২টার পর তারিখ পরিবর্তিত হয়) ৭ মে ১৮৬১, মঙ্গলবার, রাত ২টো ২৮ মিনিট ৩৭ সেকেণ্ড গতেশকাব্দ ১৭৮৩, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে (সূত্র : ‘জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ’, কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত, পৃঃ ২)। ৮০টা ২৫শে বৈশাখ দেখে যাওয়াসৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের, সে অর্থে শিয়ালদহ স্টেশন ও রবীন্দ্রনাথ সমবয়সী।
     ছেলেবেলায় পরপর কয়েকটি স্কুলে রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হলেও স্কুলের বাঁধাধরা রুটিনের জীবন ভালো না লাগায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তেন বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, ব্যাকরণ, জ্যামিতি ও বিজ্ঞান। ছোটবেলা থেকেই কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি ছিল সহজাত প্রবণতা। ভাগ্নে জ্যোতিপ্রকাশের কাছে কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় তাঁররচনা করেছিলেন অসামান্য গীতাঞ্জলি’। পেয়েছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার’। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের পুরস্কার, সেদিন বাংলারই কবি হলেন বিশ্বকবি
     রবীন্দ্রনাথের জীবনে ‘২৫শে বৈশাখ দিনটি ছিল এক বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। ২৫ বছর পূর্ণ করে ২৬এ পদার্পণ করার পর তিনি তাঁর বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে বলেছিলেন, “আজ আমার জন্মদিনপঁচিশে বৈশাখ২৫ বৎসর পূর্বের এই পঁচিশে বৈশাখেই আমি ধরনীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুমজীবনে এমন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্ব্বাদ করুন।…” (সূত্র : রবিজীবনী, , পৃঃ ৩৮)। ২৭ বছর বয়সে, ঘরোয়া গণ্ডীর মধ্যে তাঁর প্রথম জন্মোৎসব পালিত হয় ১৮৮৭ সালে (১২৯৪ বঙ্গাব্দ), ভাগ্নি সরলা দেবীর (স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের কন্যা) উদ্যোগে। সরলা দেবী তাঁর ঝরাপাতাগ্রন্থে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব করাই আমি। অতি ভোরে উল্টাডিঙ্গির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলে নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাঁদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেনপাশেই নতুনমামার ঘর। রবির জন্মদিনবলে একটি সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হয়।”
     ঘরোয়া গণ্ডীর বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালিত হয় শান্তিনিকেতনে, তাঁর ৪৯ বর্ষপূর্তিতে, ১৯১০ সালে (১৩১৭ বঙ্গাব্দ) ছাত্র, শিক্ষক ও সাহচর্যে। এর আগে তা পারিবারিক বৃত্তে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্ষিতিমোহন সেন বলেছেন, “২৫ বৈশাখ কবি পারতপক্ষে আশ্রমে বাইরে থাকতে চাইতেন না। তিনি বলতেনঅন্য কোথাও থাকলে আমার মনে হয় আমি বৃদ্ধ, এইখানে এই সব শিশুদের মধ্যে থাকিয়া আমি যেন আমার হারানো শৈশবকে ফিরিয়া পাই। শারদোৎসব নাটকে ঠাকুরদার মুখে আমি আমার রহস্যটি ব্যক্ত করিয়াছি।” (সূত্র : শিক্ষাব্রতীঃ রবীন্দ্রসংখ্যা, ১৩৬১, পৃঃ ৩৯)। ১৯৩৬ সাল (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রচণ্ড জলকষ্ট হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ ১লা বৈশাখেই নববর্ষ ও জন্মদিন, দুটি উৎসবকেই সম্মিলিত করেন।
     শান্তিনিকেতনে আজও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মহাসমারোহে উদ্‌যাপিত হয়। গানে, আবৃত্তিতে, নাচে, অভিনয়ে ভরে ওঠে এই দিনটি। ছাত্রছাত্রী, কর্মি, অধ্যাপক, আশ্রমিক সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাদিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। সারাদিনের বিশেষ কর্মসূচির মধ্যে থাকেভোর ৫টায় গৌরপ্রাঙ্গণে বৈতালিক (এ দিন আজি কোন ঘরে গো’), উপাসনাগৃহে সকাল ৭টায় উপাসনা, সকাল ৮:৪৫এ মাধবীবিতানে জন্মদিন পালন, ১০টায় উত্তরায়ণে গ্রন্থপ্রকাশ, সন্ধ্যা ৭টায় গৌরপ্রাঙ্গণে গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে বিশ্বভারতীর দুই বিদ্যালয় পাঠভবন বা শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ বৈশাখে মঞ্চস্থ হয়চণ্ডালিকা (শিক্ষাসত্র, ২০১২), চিত্রাঙ্গদা (পাঠভবন, ২০১৩), চণ্ডালিকা (শিক্ষাসত্র, ২০১৪), চিত্রাঙ্গদা (পাঠভবন, ২০১৫), ভানুসিংহের পদাবলী (শিক্ষাসত্র, ২০১৬), শাপমোচন (পাঠভবন, ২০১৭), চিত্রাঙ্গদা (শিক্ষাসত্র, ২০১৮), তিনকন্যা (পাঠভবন, ২০১৯)। কিন্তু, এই বছর বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে সমস্ত অনুষ্ঠান স্থগিত আছে।
     জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ছাপ্পান্ন বছর বয়সে প্রথম জন্মদিন পালিত হয়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈঠকখানায়। রবীন্দ্রনাথ সেদিনের উৎসবের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন তবু মনে রেখোগানটি গেয়ে। ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জীবনে নিয়ে আসে জন্মের স্মারণিক বাণী, ‘দ্বারে আসি দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’। এই দিনকে কেন্দ্র করে তাঁর রচনাসম্ভার ভালো লাগার আলিম্পনে ভরিয়ে তুলেছেন। জন্মদিনে লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হলজন্মোৎসব (২৫ বৈশাখ ১৩১৭, ‘ভারতী পত্রিকা’, ১৩১৭), জন্মদিনে (২৫ বৈশাখ ১৩৩৩, ‘প্রবাসী’, আষাঢ় ১৩৩৩), কবির অভিভাষণ (২৫ বৈশাখ ১৩৩৮, ‘প্রবাসী’, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮), জন্মদিনে (১৩৪৩, ‘প্রবাসী’, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৩), জন্মদিনে (১ বৈশাখ ১৩৪৭, শান্তিনিকেতন, ‘প্রবাসী’, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭), আশীর্বাদ (১ বৈশাখ  ১৩৪৮, ‘নির্বাণ, ১ বৈশাখ ১৩৪৯, পৃ. ৪৮)।
     রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, “বস্তুত, নিজের জন্মদিন বৎসরের অন্য ৩৬৪ দিনের চেয়ে নিজের কাছে কিছুমাত্র বড়ো নয়। যদি অন্যের কাছে তার মূল্য থাকে তবেই তার মূল্য।” (জন্মোৎসব, ২৫ বৈশাখ ১৩১৭, ‘ভারতী’, ভাদ্র ১৩১৭)। মর্ত্য জীবনের শেষ জন্মদিনের ২ দিন আগে, ২৩ বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে তাঁর লেখা পূরবীকাব্যের পঁচিশে বৈশাখকবিতাটি ভেঙে তিনি লিখেছিলেন, ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। তিনি নিজেও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, শতবর্ষের ব্যবধানে তাঁকে দেশবাসী মনে রাখবেন কি না? তাই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে / কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতুহল ভরে।কিন্তু দেশবাসী কবিকে ভুলে যায়নি, কেননা তিনি যে আমাদের জাতীয় কবি, প্রাণের কবি। তিনি নিজেও চেয়েছিলেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক
     রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রজয়ন্তী বা জন্মোৎসব পালন বর্তমানে একটি ব্যক্তিগত উৎসব থেকে জাতীয় ও ক্রমে আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে। অথচ তাঁর জীবনের প্রথম দিকে এই বিশেষ দিনটি ঠাকুর পরিবারেও ছিল গুরুত্বহীন। প্রথম দিকে গুণীজনদের আলোচনা ও নাগরিক সম্বর্ধনা প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কবির মৃত্যুর পর, বিশেষ করে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর বছর থেকে উৎসবের আয়োজনেও বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন একটি জন্মতিথি থেকে একটি উৎসব দিবসে পরিণত হয়। দুই বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে পাড়ার ক্লাবগুলিতে বৈশাখের ২৫ তারিখ থেকে শুরু করে শ্রাবণের ২১ তারিখেও তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপিত হয়। তাঁর জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর প্রতিভাখণ্ডকালের হয়েও তিনি সর্বকালের। রবীন্দ্রপ্রতিভার এমন গভীরতা, ব্যাপকতা ও সর্বত্রগামীতা রবীন্দ্রোত্তরকালের মানুষের কাছে সত্যিই বিস্ময়কর। কবিকূল চূড়ামণি রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকার, আমাদের দেশের ও জাতির গৌরব।
     বর্তমান প্রজন্মও অনুধাবন করেছে, কবির জন্মোৎসব পালনের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা কি? রবীন্দ্রনাথ নিজেই সে কথা পেড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি কররে সেই দিন।” ১৯৩১ সালে জন্মদিন পালন উপলক্ষে কবি এই কথাটি ভিন্নভাবে বলেছিলেন, “আমাকে গ্রহণ করার দ্বারা দেশ যদি কোনোভাবে নিজেকে লাভ না করে থাকে তবে আজকের উৎসব ব্যর্থ”। এখানেও সেই লাভ করার কথা, সেই উপলব্ধির প্রসঙ্গ। কবির জন্মোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে আমরা আপনার মনুষ্যত্বের শক্তিউপলব্ধি করতে পারি। বর্তমান ২০২০ বর্ষে বিশ্বময় করোনা সংক্রমণের সতর্কে লকডাউনের জেরে অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে গৃহবন্দি রবীন্দ্র প্রেমীরা, রবীন্দ্র-জয়ন্তী উদযাপনেও ঘটেছে ছন্দপতন। হে সখা মম, হৃদয়ে রবগান গেয়ে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে রবীন্দ্র-মূর্তিতে মাল্যদান করে সম্পূর্ণ অনাড়ম্বরভাবে সর্বত্র কবিগুরুর জন্মদিবস পালন করলেন রবীন্দ্র-অনুরাগারীরা।
(লেখক পল্লী শিক্ষা ভবন গ্রন্থাগারের কর্মি ও পল্লী সম্প্রসারণ কেন্দ্রের গবেষক)
  • All Rights Reserved
Advertisement
Previous articleকরোনা শাসিত পৃথিবীতে আগামী দিনে বুদ্ধের বাণী পথ দেখাতে পারে
Next articleকরোনায় মানুষের পাশে দাঁড়ালো মাধাইপুর পল্লী মঙ্গল স্কুল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here