কথিত রয়েছে, এই পুকুরে আগে নাকি ‘যক’ থাকত তার বিশাল ধনরত্নসম্ভার নিয়ে। ফলে এই ভীতি থেকেই পুকুরের ঘাটের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিল বেশ অবহেলার। কেউ ধারে কাছে ঘেঁষতেন না সেসময়ে। এও শোনা যায়, কোনও দরিদ্র ব্যক্তি তাদের কোনও অনুষ্ঠানের (বিবাহ বা ওইরকম) পূর্বে বাসনপত্র চেয়ে লিখে গেলে পরদিনই সকালে ঘাটে সেই বাসনপত্র অলৌকিকভাবে হাজির হত। তবে তা আবার পরিস্কার করে ফেরত দিতে হত। অন্যথায় ঘটত বিপদ। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সৌম্যদীপ্ত বোস : দেরিয়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অতি পরিচিত গ্রাম। গ্রামটির এই নামের তাৎপর্য নিয়ে যদিও পন্ডিত মহলে কিছুটা বিতর্ক এখনও রয়েছে। সেই প্রতিটা অ্যাসাম্পসানকে যদি তুলে ধরা হয়, তা হবে এই রকম –
১. দেরিয়া নামটির উৎপত্তি ফারসি শব্দ ‘দরিয়া’ থেকে। যার অর্থ নদী। নদীর কাছাকাছি এর অবস্থানকে যদিও হেয় করা যায় না। তবে ধরতে হয় গ্রামটি মুসলিম শাসনের সমকালীন বা তারও পূর্বে হয়তো অন্য কোনও নামে অস্তিত্ব ছিল।
২. দেরিয়া শব্দটির আরেকটি উৎপত্তি ‘দারেয়া’ (গাছ) বা ‘দেরিয়া’ (কাঠুরিয়া) থেকে। গাছকে অনেক স্থানে বিশেষত সাঁওতালদের মধ্যে ‘দারি’ বলে ডাকা হয়। যখন আলিবর্দি খাঁর সময় ঘোষ পরিবার বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে এ অঞ্চলে আসে, তখন প্রথমে জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করে তারা। ফলে এই গাছ বা দারি থেকেও গ্রামটির নাম আসতে পারে বলে অনেকের মত। যদিও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণের অভাব রয়েছে, আর এটা না হওয়ার পক্ষে কারণও অনেক বেশি।
হ্যাঁ, তবে এটা বলা যেতেই পারে, উভয় ক্ষেত্রে একটাই সত্য, যা অপরিবর্তনীয় তাহল ‘মুসলিম শাসন’। সুতরাং এটা মেনে চলা যেতে পারে, গ্রামটি খুব বেশি হলে ৩০০ থেকে ৩৫০ বছরের পুরনো। এখানকার পূর্বতন জমিদার ঘোষ পরিবারের জমিদারির পত্তন ও তার সীমানা প্রসঙ্গে বলতে গেলে গ্রামের বর্তমান আর্থ-সামাজিক দিকটি দারুণভাবে জড়িয়ে পড়ে।
যাইহোক, গ্রামটির সবচেয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে এখানকার ‘পদ্ম পুকুর’। কারণ এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ‘যক’ এবং তা থেকে ‘যকভীতি’। পুকুরটি সম্ভবত নির্মাণ করেছিলেন যশোর থেকে ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ চলে আসা ও দেরিয়া (কুলপী, দঃ ২৪ পরগনা) গ্রামের পত্তনকারী ঘোষ’রা। তখন তাঁরা ছিলেন জমিদার। আজও তাদের পূর্বপুরুষের নামে বেশ কয়েকটি গ্রামের নাম আছে এ অঞ্চলে।
কথিত রয়েছে, এই পুকুরে আগে নাকি ‘যক’ থাকত তার বিশাল ধনরত্নসম্ভার নিয়ে। ফলে এই ভীতি থেকেই পুকুরের ঘাটের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিল বেশ অবহেলার। কেউ ধারে কাছে ঘেঁষতেন না সেসময়ে। এও শোনা যায়, কোনও দরিদ্র ব্যক্তি তাদের কোনও অনুষ্ঠানের (বিবাহ বা ওইরকম) পূর্বে বাসনপত্র চেয়ে লিখে গেলে পরদিনই সকালে ঘাটে সেই বাসনপত্র অলৌকিকভাবে হাজির হত। তবে তা আবার পরিস্কার করে ফেরত দিতে হত। অন্যথায় ঘটত বিপদ।
শুধু এই পদ্ম পুকুর নয়, ধামনগরের দীঘির সান, জয়নগর মৌজার হেদুয়ার পুকুর ও আরও অনেক পুকুরেই এই যকের লোকশ্রুতি প্রচলিত ছিল। আর আশ্চর্যজনকভাবে যকভীতি প্রচলিত পুকুর বা সংলগ্ন অঞ্চল থেকেই উদ্ধার হয়েছে মূল্যবান সব প্রত্নবস্তুসমূহ। যেমন, পুরন্দরপুরে হালদার-চাঁদনী পুকুর সংস্কারের সময় বিনয়ভূষণ চট্টোপাধ্যায় প্রস্তর ভাস্কর্যের সঙ্গে শ্লেট নির্মিত তিনটি বুদ্ধমূর্তি পান। যদিও বর্তমানে অতি সাধারণীকরণের কারণে যকভীতি বহুলভাবে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে ছোটদের ভীতি প্রদর্শনের কারণে যে কোনও পুকুরের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। তবে অতীত অন্য কথা বলে।
এই যকভীতি তৈরির বেশ কতকগুলি কারণ ছিল –
১. সেসময়ে গ্রামের সম্বল পানীয় জলের পুকুরগুলিকে পরিশুদ্ধ ও সংরক্ষিত রাখতে জমিদার কর্তৃক প্রচলিত হয়েছিল।
২. ডাকাতের ভয়ে সমৃদ্ধ ঘরের মানুষেরা নিজেদের সম্পত্তি ঘড়ায় ভরে পুকুরে লুকিয়ে রাখতেন। তাই সাধারণ মানুষদের এর কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হত না। অনেক সময় পুকুর সংস্কারে ঘড়া ভরা মোহর আবিস্কারও এক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। (তবে তার আরও প্রাচীন কোনও গল্প থাকতে পারে)
তবে, যকভীতি অধ্যুষিত পুকুরগুলির মত দেরিয়া গ্রামের এই পুকুরটিও ধনরত্নে বা প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ, এমন কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। হয়তো সঠিক অনুসন্ধানে কোনও একদিন পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু গবেষণার বড্ড অভাব এখানে। তার পরেও স্থানীয় গ্রামবাসীরা ভবিষ্যতে এক্সকেভেশানের অপেক্ষায় রয়েছে।