এক সময়ে জমিদার পরিবার আর নব্য ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল দুর্গোৎসব। পরে কালের বিবর্তনে জমিদার আর নব্য ব্যবসায়ীরা দুর্বল হতে শুরু করে। যার প্রভাব পড়ে দুর্গোৎসবের উপরও। ক্রমে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত এই দুর্গোৎসব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ১৭৯০ সাল নাগাদ গুপ্তিপাড়ার এই রকমই একটি দুর্গোৎসব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ওই অঞ্চলের ১২ জনের সহযোগিতায় আবার নতুন করে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত এই দুর্গা পুজোকে অনেকে বারোইয়ারি বা বারোয়ারী দুর্গা পুজো বলেছেন। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

রেমা মণ্ডল : ২০০১ সালের পর অনেকটা ব্যতিক্রমী ঢঙে মা এবার গোটা আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে হাজির হবে পাড়ার পুজোর মণ্ডপে। পুজোর মণ্ডপ বলতে এখানে বারোয়ারী বা সার্বজনীন দুর্গা মণ্ডপের কথা বলা হচ্ছে। এক সময়ে যে দুর্গা পুজোর আয়োজন করার সামর্থ্য ছিল না সাধারণ মানুষের, কতকগুলি ধনী জমিদার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন, পুজো প্রাঙ্গণে প্রবেশের অধিকার পর্যন্ত ছিল না সেকালের দরিদ্র মানুষগুলির, সেই দুর্গা পুজো-ই কালের বিবর্তনে প্রথমে রূপ পেল বারোয়ারীতে, তারপর বদলে গেল সার্বজনীন দুর্গোৎসবে।
সেকালে একাধিক জমিদার বাড়িতে এই দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র ইংরেজ সাহেবদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে। যাতে সাহেবদের কৃপা দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ থাকে জামিদারদের উপর। এর পাশাপাশি নিজেদের বিত্ত-বৈভব প্রদর্শনেরও সুযোগ ছিল এখানে। পরে সেই জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোয় ভাগ বসাতে এগিয়ে আসে বাংলার এক শ্রেণীর নব্য ব্যবসায়ী। তাঁদের উদ্দেশ্যও ছিল সেই ইংরেজ সাহেবদের খুশি করানো।
কিন্তু পরে এই জমিদার আর নব্য ব্যবসায়ীরা ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। সেসময়ে অত্যধিক আমোদ-বিলাসী জীবনই তাঁদের ভাঁড়ার শূন্যে নামিয়ে এনেছিল। খুব শীঘ্রই তাঁদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গোৎসবও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। শোনা যায়, ১৭৯০ সাল নাগাদ হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ায় এরকমই একটি দুর্গোৎসব অর্থাভাবে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন ওই অঞ্চলের ১২ জন মিলে সেই দুর্গোৎসবকে আবার নতুন করে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। উর্দু ভাষায় বন্ধুকে ‘ইয়ার’ বলা হয়ে থাকে। আর বারোজন বন্ধু মিলে সেই দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিল বলে তখনকার সময়ে অনেকেই সেই পুজোকে ‘বারোইয়ারি পুজো’ নাম দিয়েছিল। পরে এই ‘বারোইয়ারি’ নামটি ‘বারোয়ারী’ নামে পরিবর্তিত হয়। ইতিহাসে এই বারোয়ারী দুর্গা পুজোকে প্রথম সার্বজনীন দুর্গা পুজোরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যদিও প্রচলিত সার্বজনীন দুর্গা পুজো এসেছে আরও অনেক পরে।
প্রথম দিকে বারোয়ারী দুর্গা পুজোয় বিরোধও এসেছে অনেক। ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে, যে কোনও কাজের শুভ সূচনায় বিরোধ আসাটাই ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বারোয়ারী দুর্গা পুজোতেও তার অন্যথা হয়নি। শোনা যায়, কোনও ব্রাহ্মণই প্রথম অবস্থায় গুপ্তিপাড়ার সেই বারোয়ারী দুর্গা পুজোর পৌরোহিত্য করতে চাননি। শেষে একজন কম বয়সী ব্রাহ্মণ এগিয়ে এসেছিলেন পুজো সম্পন্ন করতে। বলা বাহুল্য সেদিনের বারোয়ারী দুর্গা পুজোর সূচনায় জমিদার ও ধনী ব্যবসায়ীদের প্রাসাদ ছেড়ে প্রথম বারের জন্য মা দুর্গা নেমে এসেছিল ‘সার্বজনীন মা’ হয়ে।
গুপ্তিপাড়ার সেই ১২ জন যে দুর্গা পুজোর শুভ সূচনার পথ দেখিয়েছিল, পরে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র। মফস্বল ছেড়ে গ্রামগুলিতেও শুরু হতে থাকে একের পর এক বারোয়ারী দুর্গা পুজো। অবশ্য শহর অঞ্চলে এই বারোয়ারী দুর্গা পুজো শুরু করতে বেশ কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, বারোয়ারী পুজো প্রথম দিকে গণতান্ত্রিক কায়দায় শুরু হলেও সামন্তপ্রথার কাঠামো ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে আরও কয়েক দশক লেগে যায়।
অসাধারণ 🙏