Advertisement
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : সর্বকালের দুই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারটি একটি অত্যন্ত বিস্ময়কর বিষয়। রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও বিশ্ব তত্ত্ব সম্পর্কে ভালো রকম অবগত ছিলেন। ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে তিনি একটি বইও লিখেছিলেন। অপরপক্ষে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানী হলেও পাশ্চাত্য মার্গসংগীতে প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বেহালা বাদক হিসেবে তিনি তো রীতিমত খ্যাতি লাভ করেন। তার ওপর একজন ছিলেন দার্শনিক কবি, অপরজন দার্শনিক বিজ্ঞানী।
রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন এর মধ্যে সাক্ষাৎ হয় মোট চারবার। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবার (১৯২১ খ্রিঃ) জার্মানি যান তখন তাঁদের দেখা হয়নি। দ্বিতীয়বার যখন রবীন্দ্রনাথ জার্মানি গেলেন তখন (১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ খ্রিঃ) তাদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ওই দিন রবীন্দ্রনাথের সম্মানে জার্মানির তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী বেকার একটি চা-চক্রের আয়োজন করেন। সেইখানেই প্রথম সাক্ষাৎ হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইনের। বিকেলে তিনি আইনস্টাইনের আমন্ত্রণে বার্লিনের উপকণ্ঠে কাপুথের (Caputh) ‘আইনস্টাইন ভিলা’-য় তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে কথাবার্তা হয় তার অংশবিশেষ ১৯৩০ সালের ১০ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘Einstein and Tagore plumb The Truth’ নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি লেখেন আইনস্টাইনের সৎ মেয়ে মার্গোর স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক দিমিত্রি মারিয়ানফ। এছাড়া ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই তাদের দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। তৃতীয় বার ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং চতুর্থ ও শেষ সাক্ষাৎ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ১৯৩০ সালের ১৫ ডিসেম্বর।
প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার ছাড়াও দুজনের মধ্যে পত্রের মাধ্যমে নিবিড় সখ্যতা বজায় ছিল। জার্মান ভাষায় আইনস্টাইনের নিজের হাতে লেখা দুটি চিঠিও রবীন্দ্র ভবনের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।
সাক্ষাৎকারের আলোচ্য বিষয়বস্তু নিয়েও কিছু ভিন্নমত আছে। কারণ স্বয়ং আইনস্টাইন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘The Modern Review’ পত্রিকাতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি দেখে অসন্তুষ্ট হন। পরে ‘The American Hebrew’ পত্রিকাতে এই সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলে তিনি কতগুলি বিষয় স্বহস্তে কেটে দেন। এর মূল কারণ ছিল ভাষাগত বাধা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘My memories of Einstein’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আর আমি জার্মান ভাষা জানিনা। দোভাষীর পক্ষে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না’। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ তার কথার মধ্যে Perfect man, Devin man, Supreme man, Universal being, Universal mind প্রভৃতির মত গভীর ব্যঞ্জনাময় শব্দ ব্যবহার করে সাক্ষাৎকারটিকে আরও জটিল করে তোলেন। এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের ভাবের আদান-প্রদান ছিল অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক। যদিও এখানে সেই সুসংবদ্ধ সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ততম রূপও তুলে ধরার অবকাশ নেই। তবু কিছু কথা তুলে ধরা হলো। যদিও তাতে অনেক অসম্পূর্ণতা ও বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যাবে।
আইনস্টাইনের প্রশ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরের ঐশী শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন কিনা? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে তা উপলব্ধি করেন না। তাঁর বিশ্বাস তেমন কোন বিষয় থাকতে পারে না যা মানব চেতনা থেকে উপলব্ধ হয় না। তাই এটা থেকেই প্রমাণ হয় বিশ্বের সত্যই মানব সত্য। আইনস্টাইন তার নিজের ধারণা ব্যক্ত করে বলেন, প্রথমত বিশ্বের সামগ্রিক রূপ বিবেচনা করলে এটি মানুষের চেতনার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাস্তবতার দিক থেকে বিচার করলে ‘বিশ্ব’ মানুষের চেতনা নির্ভর নয়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন সৌন্দর্যের ধারণা মানুষের চেতনা নির্ভর। মানুষ না থাকলে সৌন্দর্য উপভোগ করার কেউ থাকবে না। এ বিষয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত। কিন্তু পিথাগোরাসের থিওরোমের উপপাদ্যের সত্যটি মানুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে না। তাই বিশ্বের ঘটনাবলীর সত্যতার জন্য মানুষের অস্তিত্বের কোন প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে মতৈক্য হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের আলোচনায় উঠে আসে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, মেন্ডেলের গণিতে নতুন আবিষ্কার, ভারতীয় দর্শনে ব্রহ্ম, বিশ্ব পরিস্থিতি, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় মার্গসংগীতে ভাষা, ভাব ও রাগরাগিণীর প্রয়োগ, প্রভৃতি নানা বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংগীতের আলোচনায় আইনস্টাইন সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে সে কথা জানিয়ে তিনি বলেন আলোচনা থেকে তিনি বুঝতে পারলেন ভারতীয় সংগীতের কাঠামো পাশ্চাত্য সংগীতের থেকে অনেক সমৃদ্ধ। সমস্ত আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া না গেলেও আলোচ্য বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে দুই অসামান্য প্রতিভাধরের কথোপকথন ছিল সুগভীর ও উচ্চতানে বাধা। যা বিশ্ব ইতিহাসের এক অসামান্য প্রাপ্তি।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার লেখায় আইনস্টাইনের বিষয়ে তার উপলব্ধি ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন, “একক নিঃসঙ্গ মানুষ বলে আইনস্টাইনের খ্যাতি আছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছের ভিড় থেকে গাণিতিক ভাবনা ও দৃষ্টি মানুষের মনকে মুক্তি দেয় যেখানে, সেখানে তিনি একক বৈকি। তাঁর জড়বাদকে তুরীয়ই বলা চলে, দার্শনিক ধ্যানধারণার সীমান্ত-চুম্বি, সীমাবদ্ধ অহমের জটিল জাল থেকে, জগত থেকে নিঃসম্পর্ক মুক্তি হয়তো সেখানে সম্ভবপর। আমার কাছে বিজ্ঞান এবং আর্ট দুটিই মানুষের স্বরূপ প্রকৃতির প্রকাশ, জৈবিক প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বাইরে, আর আপনাতেই আপনার তার অসীম এক সার্থকতা আছে।” রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়ন থেকেই দুই দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যথাযথভাবে ধরা পড়ে।
যাইহোক, দুই ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচন্ড কৌতুহল ছিল। রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের বাড়ি থেকে বের হতেই সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। প্রশ্ন করেন, আপনি তো বর্তমান কালের সেরা বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বললেন। কেমন লাগল তাঁর বিজ্ঞান ভাবনা? রবীন্দ্রনাথ চকিতে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি তো কোনও বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ করিনি। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এক অসামান্য কবির”। সাংবাদিকরা গুরুদেবের কথা ধরতে পারলেন না। তারা আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করলেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিকে পাশে পেয়ে আপনার কেমন লাগলো? রসিক আইনস্টাইন হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “কোথায়! আমি তো আলাপ করলাম এক অসামান্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে”।
Advertisement