Advertisement
শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যখন রামনগর-সাহোড়া স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই স্কুলটি তখন ছিল ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। পরে প্রধান শিক্ষক কালীপ্রসন্ন দত্তের উদ্যোগে স্কুলটি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। সেসময়ে স্কুল উন্নীত করার ব্যাপারে কালীপ্রসন্নবাবুকে মৃত্যুঞ্জয়বাবু সর্বক্ষণের জন্য সহযোগিতা করেছেন। তারপর দীর্ঘদিন এই স্কুলের শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
|
বিজয় ঘোষাল : ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সব সময়ই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ এতে শিক্ষক ছাত্রের মৌলিক চাহিদাগুলি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে বীরভূম জেলার রামনগর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাহোড়া গ্রামের প্রান্তে গড়ে ওঠা রামনগর-সাহোড়া বিদ্যালয়ের জন্ম লগ্নের সময় থেকে শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের মূল্যায়ন ছিল এতটাই।
তাঁর বয়স এখন প্রায় ৯৫ বছর। বয়সের ভারে দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছে। লিখতে গেলেই হাত কেঁপে ওঠে। কিন্তু রামনগর-সাহোড়া স্কুলের জম্মলগ্নের স্মৃতি আজও যেন জ্বলজ্বলে তাঁর কাছে। স্মৃতি এখানে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ পায়নি। একটির পর একটি ইট সাজিয়ে স্কুলকে ক্রমশ মহীরুহ করে তোলার বাস্তব কাহিনী আজও তিনি তাঁর স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন।
শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৭ নভেম্বর বর্ধমান জেলার কটোয়া মহকুমার মুর গ্রামে। বাবা ইন্দিবরাক্ষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশকর্মী, যিনি সেকালে আঙুলের ছাপ দেখে অপরাধী সনাক্ত করাতে পশ্চিমবঙ্গের ছয় জেলার মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী ছিলেন। বাবা পুলিশে থাকাকালীন মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বাল্যকাল কেটেছে মুরারইয়ে। লাভপুর যাদবলাল স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। সেই সময় তিনি মহাত্মা গাঁধী নির্দেশিত ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচীতেও অংশগ্রহণ করেছেন যাদবলাল স্কুলের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে।
![]() |
মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় |
ম্যাটিক পাশ করার পর বাবা তাঁকে ডাক্তারি পড়তে সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হতে বলেছিলেন। কিন্তু বরাবরের সাহিত্যানুরাগী মৃত্যুঞ্জয়বাবু সায়েন্স নিয়ে পড়তে চাননি। তখন তাঁর বাবার মাসিক মাহিনা ছিল মাত্র ৪০ টাকা। আর কলেজে সায়েন্স নিয়ে পড়ার খরচ ছিল মাসিক প্রায় ৫০ টাকা। প্রবল অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও সায়েন্স নিয়েই ভর্তি হতে হল তাঁকে। কিন্তু বাবার প্রত্যাশা মতো ফল করতে পারলেন না তিনি। তাই ডাক্তারিও আর পড়া হল না তাঁর।
অন্যদিকে এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের কাছে মিথ্যা অভিযোগে বাবা ইন্দিবরাক্ষ অপমানিত হয়ে স্বেচ্ছায় পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন এবং রামনগর চলে আসেন। তীব্র দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই শুরু হয় তখন থেকেই।
রামনগর-সাহোড়া স্কুলে তখন ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বছর ষাটের কালীপ্রসন্ন দত্ত। সেসময়ে তিনি এই মাইনর স্কুলকে হাইস্কুলে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছেন। রামনগরের অধিকাংশ পড়ুয়া সেকালে ম্যাট্রিক পাশের জন্য নদী পেরিয়ে লাভপুরের বোডিং-এ আসত পড়াশোনা করতে। তাই হাইস্কুলের বড্ড প্রয়োজন ছিল এই অঞ্চলে।
কিন্তু সমস্যা একটাই, অর্থ। হাইস্কুল গড়তে প্রয়োজন প্রচুর টাকার। টাকার চেয়ে আবার বেশি প্রয়োজন এই কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার সম-মনস্ক মানুষের। যদিও যে কোনও ভালো কাজের জন্য এই দুটি সমস্যা চিরকালই রয়ে গিয়েছে। সেদিনের ‘কালীমাষ্টার’-এর এই ইচ্ছার সঙ্গে সহমত ছিলেন না তাঁর নিজেরই সহকর্মীরা।
ঠিক এমন অবস্থাতেই কালীমাষ্টার আবিষ্কার করে ফেললেন বছর আঠারোর মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে। তাঁর মধ্যেই তিনি খুঁজে পেলেন ওই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান। কিশোর মৃত্যুঞ্জয়কে সঙ্গে নিয়েই শীত-বর্ষা-খরা উপেক্ষা করে মানুষের দরজায় দরজায় ছুটে বেরিয়েছেন স্কুলের তহবিল গঠনের চেষ্টা করতে। অনুদানের পরিমান ছিল মাত্র একআনা, দু-আনা অথবা চার আনা।
![]() |
কালীপ্রসন্ন দত্তের আবক্ষ মূর্তি |
গড়ে তোলা হল স্কুল কমিটি। সভাপতির পদে থাকলেন রামনগর গ্রামের তৎকালীন জমিদার ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সম্পাদক হলেন প্রধান শিক্ষক কালীপ্রসন্ন দত্ত এবং কোষাধ্যক্ষ হলেন রামনগরের সেই সময়কার অন্যতম ধনী ব্যক্তি শিবদাস দত্ত। ঠিক হল ১৯৪৬ সালের ১৮ জানুয়ারি স্কুলের নতুন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।
ওই বছরই সামান্য কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে শুরু হল সপ্তম শ্রেণীর পঠন-পাঠন। যা এতদিন ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিশোর মৃত্যুঞ্জয়বাবুও যোগ দিলেন শিক্ষকতার কাজে। তখন স্কুল ছিল মাটির। উপরের ছাউনি ছিল খড়ের। ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই রামনগর-সাহোড়া স্কুলটি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হল। সেই সঙ্গে বদলে গেল এই অঞ্চলের পড়ুয়াদের পঠন-পাঠনের জীবনযাত্রাও।
স্কুলকে মৃত্যুঞ্জয়বাবু আজীবনই মানুষ গড়ার কারখানা হিসাবে দেখে এসেছেন। তাঁর প্রাক্তন ছাত্রদের অধিকাংশই এখনও বলে থাকেন, বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, অংকে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর জ্ঞান ছিল অগাধ। বাংলা ছন্দ নিয়ে এক সময়ে তিনি গভীর গবেষনা করেছেন। যদিও তাঁর কোনও লেখা বই আকারে প্রকাশ হয়নি। তাঁর হাতে গড়া ছাত্রদের মধ্যে আজ কেউ ডাক্তার, কেউ গবেষক, কেউ বা শিক্ষক। দেশের বাইরেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেকে।
দেখতে দেখতেই পেরিয়ে গিয়েছে ৭৫টি বছর। আর সেই মাস্টারমশাইয়ের বয়স এখন ৯৫ বছর। অনেক উত্থান-পতন ও অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছেন তিনি। রয়ে গিয়েছেন জীবন্ত ইতিহাস হয়ে। খুব কম জনেরই সুযোগ ঘটে এই রকম আর্দশ একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়ার, তার আদর্শ গ্রহণ করার। রামনগর-সাহোড়া বিদ্যালয় শুধু তাঁর হাতে গড়া স্কুল নয়, এই স্কুল যেন তাঁর পালিত মানসকন্যা।
Advertisement
সমাজে এমন শিক্ষক দের ভীষণ প্রয়োজন