তৃষ্ণার্ত কাক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা

Advertisement
3
প্রীতম সাহা : তৃষ্ণার্ত কাকের সেই ছবিটা মনে আছে? নুড়ি পাথর ফেলে কলসি থেকে জলপান করার কায়দা। কিন্তু ছবিটা যদি এখানে সেটা না হয়ে খানিকটা এগিয়ে যায়, তবে কেমন হয়? অর্থাৎ কলসিও ছিল, তাতে নুড়িও ফেলা হল, কিন্তু জলের স্তর উপরে উঠলো না; কাকটা দাপাতে দাপাতেই শান্ত হয়ে গেল। ইস্!কায়দা করে নুড়ি পাথর ফেলে একটু গলা ভেজাবে ভেবেছিল, কিন্তু তা আর হল না একেবারে টেঁসে গেল…
     টেঁসে গেল – আমাদেরই জন্য। আমাদেরই বিপুল বিস্ময়কর বিস্ফোরক কর্মকাণ্ডের জন্য। চোখের সামনে জলাশয় ছিল। পলক ফেলতেই সেখানে রাতারাতি চলে এল বহু সাধ, লোভলালসা বিজড়িত ইমারত। জলাশয় কোথায়! ওই যে শেষ সীমানা অব্দি বিস্তৃত সবুজ, যে কিনা গতকাল অব্দি অফুরান আন্দোলিত হচ্ছিল – সেসবই বা আজ কোথায়! ভাববার বিষয়, আমাদের দেশে মাথাপিছু গাছের সংখ্যা প্রায় ২৮টি যেখানে কানাডায় ৮৯৫৩টি, রাশিয়ায় ৪৪৬১টি, আমেরিকায় ৭১৬টি, চিনে ১০২টি (ইউএন প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী)। ব্রিটেনের পত্রিকা ইন্ডিপেনডেন্ট’-এর মতে, সারা পৃথিবীতে প্রায় যতগুলো আবাদি জমি আছে, তার সবকটিতে দ্বিগুণ গাছ পুঁতলেও আমাদের গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের হাত থেকে নিস্তার নেই।
     আগামি কয়েক বছরের মধ্যে সামগ্রিক চিত্রটা কী হতে চলেছে, তা কল্পনা করাও একটা বীভৎস ব্যাপার! আরও উন্নত, আরও অগ্রশীল হওয়ার যে দিবাস্বপ্নে মশগুল ছিল গোটা মনুষ্য সমাজ; যার জেরে ভোল পাল্টে গেল এই ভূ-প্রকৃতির এবং তৎসম্বন্ধীয় জলবায়ুর। সেই জলবায়ুই এবার ঠিক এই একই পন্থা অবলম্বন করতে চলেছে আমাদের সাথে।
     চেন্নাইতে এখন জীবনের (জলের) নিদারুণ অভাব! মহারাষ্ট্রেও দীর্ঘকাল ধরে চলছে খরা, মাটিতে ফাটল ধরেছে। মাথা গজিয়ে উঠছে বহু প্রাচীন মন্দির আর অভিশপ্ত ফসিল! মুম্বাইতে আবার অন্য ছবি। খরা না, সেখানকার দুশ্চিন্তা এখন প্রবল বর্ষণ। কুড়িদিনের বৃষ্টিপাত, দুদিনে! আবার সাইক্লোনের কথাও উঠে আসছে। কেরালা, ওড়িশার ছবিটাও খানিকটা আমাদের অলস, নিরেট মস্তিষ্কে জেগে আছে।
     অর্থাৎ কিনা প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে জল দিয়েই আগে শায়েস্তা করতে হবে! এই জন্য দেশে প্রতিবছর বিশুদ্ধ জলের অভাবে প্রায় দুই লক্ষের উপর মানুষের মৃত্যু ঘটে। ভূগর্ভ জলস্তর যখন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে চলেছে, তখন আমরা কিচ্ছুই টের পাইনি। আমরা শুধু বৃষ্টির জলে ভেজা রোমান্স করবার মজা নিয়েছি অথচ তখনও বুঝিনি বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে ভূগর্ভ জলস্তরের সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে

     অবিবেচকদের এখন বিবেচনা করবার দিন এসেছে। কারা অবিবেচক? আমরাই চোখের সামনে প্রতিদিন জলের যে অপচয় সেটাকে অস্বীকার করবো কীভাবে? কল খোলা, সঙ্গে আমাদের অসচেতনতা। কল থেকে হু হু করে জল গড়িয়ে পড়ছে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই যে হেলাফেলা, চোখের সামনে ঘটা জিনিসটাকে অবলোকন করেও কিছু বুঝতে না চাওয়া, এর থেকে মহাপাপ আর চরম মূর্খামি আর কী হতে পারে! যদিবা কিছু দূরদর্শী সম্পন্ন পাগল মাঝে মাঝে চোখে আঙুল দিয়ে জিনিসটাকে দেখাতে চেয়েছেন, তাও আমরা বুঝিনি।

     এখনও আমরা ঘুমিয়ে… এখনও এই বিষয়টাকে নিয়ে কোনও মাথাব্যথা দেখছি না বা দেখাচ্ছি না। সব কিছু অমূলক মনে করছি। কলকাতাতেও যে চেন্নাইএর মত অবস্থা হতে পারে তার ইঙ্গিতও পেয়েছি আমরা। দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গা তার অভিমুখ বদলাচ্ছে। জেগে উঠছে চর। মাঝগঙ্গা অব্দি প্রায় হেঁটে যাওয়া যাচ্ছে।
     তৃষ্ণার্ত কাকের ছবিটা ভালো করে একবার মনে মনে ভেবে দেখুন, কী আছে? না একটা কাকের লাশ! কলসিতে নুড়ি ফেলেও একফোঁটা জল না পেয়ে মরে পড়ে আছে। অর্থাৎ কিনা সমাজের নিচুতলার হাভাতে মানুষগুলোর গলিত পচিত মৃতাবশেষ। খুব অলীক মনে হচ্ছে কি? অলীক মনে হলে একেবারে সেই ইতিহাসে ফিরে যান। মন্বন্তরমরেছে কারা? সেই কাকের মতোই কর্কশ, অচ্ছুত, নিম্নশ্রেণীর কিছু আত্মা। আর বেঁচেছে কারা? যাদের ছিল টাকা। যারা ঘোর বিপর্যয়ের মুখেও টাকা ঢেলে নিজের আর নিজেদের পরিবারের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা পাকা করতে পেরেছিল।
     আর ঠিক এই ঐতিহাসিক স্মৃতিরই পুনরাবর্তন ঘটবে এখানে, যদি অনুমান খুব ভুল না হয়। কারি কারি নগদ টাকার বিনিময়ে জল পেতে হবে তাও আবার লিটারে সামান্য কিন্তু মজা আর ট্র্যাজেডি এখানে একটাই, কারা পাবে সে জল (যাতে এককালে ছিল সকলের সমান অধিকার)? দুবেলা কোনও মতে বেঁচেবর্তে থাকতে যাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তারা? তা দুঃস্বপ্ন। জল সংগ্রহ করতে না পেরে বুভুক্ষু প্রাণগুলো হেজে, পচে জীবাশ্মে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
     আর এইভাবেই সভ্যতারও সমূলে বিনাশ লেখা হয়ে যাবে। তারপর কতকোটি বছর পর নবসৃষ্ট কোনও সভ্যতার ইতিহাসে পড়ানো হবে, বোঝানো হবে –ও কিছু না, ও কিছু না, সামান্য একটা ব্যাপার। কায়দা করে নুড়িপাথর ফেলে একটু গলা ভেজাবে ভেবেছিল কিন্তু তা আর হল না, যাকে বলে বিফল মনোরথ। একেবারে টেঁসে গেল…”
     দেরি তো হয়েছেই তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। কিন্তু যতক্ষণ স্পন্দন আছে, ততক্ষণ আছে বাঁচার লড়াই। তাই আজ থেকেই সকলে অন্তত সচেতন হোন; অন্তত আগত বিপর্যয়ের কথা ভেবে। নইলে সামনে সমূহ বিপদ! যে বিপদের ছবি কিম্বা ইতিহাস আগে কখনও দেখেনি পৃথিবী এবং লেখেওনি।
Advertisement
Previous articleবিপন্নের মুখে কুন্ডিরার বাদ্যকর সম্প্রদায়
Next article‘কিউরিসিটি’ মঙ্গলে সন্ধান পেল চকচকে পাথরের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here