তথ্য সংক্রমণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে

Advertisement
বর্তমানে তথ্য সংক্রমণ একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই তথ্য বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকমভাবে প্রকাশ করছে। তাতে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে। আবার কিছু তথ্য লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করার চেষ্টা চলছে। এসবগুলিকেই সামাজিক অপরাধ হিসাবে গণ্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। – ছবি : সংগৃহীত

তথ্য সংক্রমণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে
পার্থপ্রতিম রায় : প্রস্তর, তাম্র, লৌহ যুগ অতিক্রম করে বর্তমানে আমরা তথ্যের যুগে বাস করছি। তথ্যই শক্তি, সর্বক্ষেত্রে তথ্যের ব্যবহার উত্তোরতর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত মানুষ অধিক তথ্য সচেতন হবেন এবং ব্যবহার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ডেটা বা উপাত্ত হল লক্ষণীয় সত্য। উপাত্ত নানাভাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে, যেমন লিখিত প্রশ্ন করে, ইন্টারভ্যু নিয়ে, অবলোকন করে ইত্যাদি। আর অনেক উপাত্তের যোগফল, সারাংশ বা বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় তথ্য।
     মনে করা যাক, একটি গ্রাম ‘ক’-এর ৬০ শতাংশ মহিলা শিক্ষিত। অপর একটি গ্রাম ‘খ’-এর ৭০ শতাংশ মহিলা শিক্ষিত। এই দুটি বিচ্ছিন্ন ডেটা। কিন্তু এই দুই বিচ্ছিন্ন উপাত্তকে একত্রে বিশ্লেষণ করলে তথ্য পাওয়া যায়, ‘খ’ গ্রামের শিক্ষিত মহিলার হার ‘ক’ গ্রামের মহিলাদের থেকে ১০ শতাংশ বেশি।
     তথ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আবশ্যিক উপাদান। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যের সরবরাহ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তথ্যের অনেক বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে। অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হল, ‘শেষ না হওয়া’। যেমন কোনও ব্যক্তির কাছে একটি তথ্য আছে, তিনি অনেকের সামনে সেটি প্রকাশ করলেন। এর ফলে ওই ব্যক্তির কাছে যেমন তথ্যটি রইল, ঠিক তেমনি অন্যান্য ব্যক্তির কাছেও রইল। তবে এর ফলে তথ্যের গুরুত্ব কম বা বেশি হতে পারে। আবার সবাই সব তথ্যের জন্য সমান আগ্রহী নাও হতে পারেন। কথায় আছে, ‘যার কথা তার কানে বাজে, বাজে কানে বাজে না’। আর এখানেই আসে তথ্য ছাঁকনির কথা, অর্থাৎ অজস্র তথ্যের ভিড় থেকে সঠিক তথ্য গ্রহণ করা। ব্যক্তি, সরকার বা সমাজ প্রতিটি স্তরের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য।
     তথ্য নানাভাবে নানা মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তির দ্বারা একজন থেকে একজন বা বহুজনে, আবার বহুজন থেকে বহুজনে। নানা ছাপা, দৃশ্য ও শ্রবণ গণমাধ্যমের দ্বারাও তথ্য সঞ্চারিত হয়। বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের প্রচার ব্যপকতা লাভ করেছে। আর এইসব মাধ্যম যথা ফেসবুক, ট্যুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে দেওয়া তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। তাই অনেক সময় সচেতনভাবে বা শুধুমাত্র মজা করার জন্য মিথ্যা বা বিকৃত আজগুবি গল্প তথ্য আকারে পরিবেশিত হয়। এইসব প্রচার বা অপপ্রচার যখন সামাজিক বা জাতীয় সমস্যা বা জীবন-মৃত্যু সম্বন্ধে হয়, তখন বিষয়টি অত্যন্ত গভীর এক সমস্যার দিক নির্দেশ করে।
     সম্প্রতি গোটা বিশ্বের প্রায় ২০০-র অধিক দেশ ভয়াবহ করোনা বা কোবিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত। এই ভয়াবহ ভাইরাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ সংক্রামিত এবং লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মহাসংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কেন্দ্র, রাজ্য সরকার, বিভিন্ন সংস্থা, ডাক্তারসহ অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ প্রসাশন, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ একাধিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে লড়াই করে চলেছে। কিন্তু এই জাতীয় বিপদের সময়ও কোভিড-১৯ নিয়ে ভুল, বিকৃত তথ্য পরিবেশনের রমরমা দেখা যাচ্ছে। নানা ভুল তথ্য বা গুজবের ফলে মানুষ আতঙ্কগ্রন্থ হয়ে পড়ছেন, প্রশাসনিক নানা সিদ্ধান্ত নিতেও অসুবিধা হচ্ছে। যাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সামন্তরাল তথ্য সংক্রমণ বা ‘ইনফোডেমিক’ বলে চিহ্নিত করেছে।
তথ্য সংক্রমণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে
     অতি সম্প্রতি ফেসবুক, ট্যুইটারে বহুল প্রচারিত মিথ্যা গল্প হল রাশিয়ার রাস্তায় সিংহ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা মানুষকে গৃহবন্দী রাখতে সাহায্য করছে। ইতালি শহরের একটি ছবি দিয়ে দেখান হয়েছে অনেক মানুষের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে আছে। সেটি আসলে বিখ্যাত একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য। এমনকি সম্প্রতি করোনা যুদ্ধের একজন অগ্রণী সৈনিক ডাক্তারের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি করোনায় আক্রান্ত। এই ধরনের মিথ্যা প্রচার হয়তো কিছু মানুষের সময় কাটানোর মাধ্যম, স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু জনমানসে, সামাজিক পরিসরে এসবের বিরূপ প্রভাব ব্যাপক। দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া তথ্য সংক্রমণে মানসিক, প্রশাসনিক,  সামাজিক ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। বর্তমান প্রেক্ষিতে কোয়ারান্টানিন-স্বেচ্ছাকৃত, স্বগৃহে বা সরকারি, সংক্রমণের সংখ্যা, নিবারণের নিত্য নতুন তথ্য এবং সর্বোপরি স্থানীয়ভাবে মিথ্যা সংক্রমণের গুজব এই সমস্যাকে বহুগুন বাড়িয়ে তুলছে। এর ফলে এই মহামারিকে রোধ করতে যারা সংগ্রাম করছেন সেইসব মানুষরাও বিভ্রান্ত হতে পারেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তথ্যগোপন করাও অর্থাৎ সংক্রমণের খবর প্রকাশ না করাও একটি সামাজিক অপরাধ।
     সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ভ্রান্ত তথ্যে প্রভাবিত হন অনেক সংখ্যক মানুষ। একটি তথ্য অনুসারে কোভিড-১৯ নিয়ে দিনে সবচেয়ে বেশী ট্যুইট করা দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান পঞ্চম। এইসব গুজবও করোনা ভাইরাসের তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণের মতো গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে। তাই এই সমস্ত মাধ্যমে শুধুমাত্র সঠিক তথ্য প্রদানকারী সংস্থা যথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্যজাল, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ওয়েবসাইট ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ব্যবহার কাম্য। অতি সম্প্রতি করোনা সংক্রান্ত নানা ধরণের তথ্যের জোয়ার রোধ করে সঠিক তথ্য তুলে ধরার জন্য ভারত সরকার নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। প্রয়োজনে সরকার তথ্য সঞ্চার সংক্রান্ত নতুন নীতি প্রনয়ণ করে সামাজিক মাধম্যের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। ‘হু’ একটি মঞ্চ তৈরী করে কোভিড-১৯ নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন রোধে তৎপর হয়েছে।
     আমাদের দেশে গ্রামস্তরের আলোকিত মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চস্তরে সঠিক তথ্য সরবরাহ করার জন্য তথ্যশৃঙ্খল গড়ে তোলা যেতে পারে। এই সামাজিক তথ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণস্তরে কর্মরত আশাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। তবেই করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই-এর সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়ার স্বার্থে এবং তথ্য সংক্রমণ বা গোপনের বিরুদ্ধেও লড়াই করা যাবে। কারণ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীর পরিসংখ্যান জরুরি। উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্য নির্ভর করবে জনসচেতনতা ও জন অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
লেখক উপ-গ্রন্থাগারিক, বিশ্বভারতী
Advertisement
Previous articleকরোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও সুস্থের হার মোটেও কম নয় ভারতে
Next articleবিরল সূর্যগ্রহণের সাক্ষী হতে যাচ্ছে ভারত

1 COMMENT

  1. ড. পার্থপ্রতিম রায়ের লেখাটি পড়লাম। সমৃদ্ধ হলাম। একটি অত্যাধুনিক বিষয়ের উপর এভাবে আলোকপাত সচরাচর দেখা যায় না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here