‘ত্রিস্তান ডি কুনহা’ এমন একটি দ্বীপরাষ্ট্র, বলতে গেলে যে গোটা পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সবচেয়ে কাছের দেশ সাউথ আফ্রিকার থেকে তার দূরত্ব প্রায় ২৮১০ কিলোমিটার। নৌপথেই একমাত্র সেখানে যাতায়াত করা যায়। তবে তা বছরে মাত্র কয়েকবার। দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ২৪৫ জন। পৃথিবীতে এখনও যে কয়েকটি দেশে করোনা সংক্রমণ প্রবেশ করতে পারেনি, ‘ত্রিস্তান ডি কুনহা’ তাদের অন্যতম। তবে করোনার প্রভাব পড়েছে সেখানে। – ছবি : সংগৃহীত |

অনলাইন পেপার : পৃথিবীর বুকে এমনও কোনও দেশ থাকতে পারে, যা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধু কল্পনাতেই আনা যায়। সেখানে নেই কোনও কোলাহল, বাতাস পুরোটাই বিশুদ্ধ। চারিদিকে সবুজ আর ছোটো-খাটো পাহাড়। মাথার উপর নীলাকাশ, যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বয়ে চলেছে হালকা মৃদু শীতল বাতাস। কখনও বা দূর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। হাজার হাজার পাখি মুক্ত প্রাঙ্গণে নির্ভয়ে বিচরণ করছে। ওড়ার ইচ্ছাও যেন তাদের নেই। নেই কোনও চোর, ডাকাত, রাজনীতি। ইন্টারনেট পরিষেবা দুর্বল। ফোনের ব্যবস্থা থাকলেও কদাচিৎ কথা বলা যাবে একেবারেই ফ্রিতে। এখানে শান্তির থেকেও যেন আরও আরও শান্তি বিরাজ করছে।
কথা হচ্ছে ‘ত্রিস্তান ডি কুনহা’ সম্পর্কে। ছোট্ট এই পাহাড়ি দেশটি সংক্ষেপে ‘টিডিসি’ নামেও পরিচিত। সমগ্র পৃথিবী থেকে দেশটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সবচেয়ে কাছের ভূখণ্ড সাউথ আফ্রিকার দূরত্বও এই দ্বীপ রাষ্ট্রের থেকে প্রায় ২৮১০ কিলোমিটার সমুদ্র পথ। মাত্র ১০ কিলোমিটার প্রশস্তের এই দ্বীপটি বর্তমানে গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্গত। অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে টিডিসি ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। পরে ধীরে ধীরে এখানে বসতি গড়ে উঠতে থাকে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় অন্য অংশের মতো টিডিসির তেমন কোনও উন্নতি ঘটতে দেখা যায়নি। এমনকি বসতির সংখ্যাও বিশেষ তেমন বাড়েনি। বরং কমে গিয়েছে।
বিবিসি সংবাদ মাধ্যমে সম্প্রতি ত্রিস্তান ডি কুনহা সম্পর্কে বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, সর্বশেষ জনগণনা অনুসারে নির্জন এই টিডিসির বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ২৪৫ জন। তার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১১২ জন ও মহিলা ১৩৩ জন। এদের প্রত্যেকেই বসবাস করছেন দ্বীপটির রাজধানী সেভেন সিজের এডিনবরাতে।

সেভেন সিজের এডিনবরা এই দেশের একমাত্র অঞ্চল যেখানে কপি শপ, পোস্ট অফিস, এমনকি একটি ছোটো স্কুল ও হাসপাতাল রয়েছে। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে কাছের ভূখণ্ড সাউথ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের উপর ভরসা করতে হয়। তবে এক্ষেত্রেও বেশ ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ কেপটাউন থেকে এই দ্বীপে নৌযোগাযোগ চলে বছরে মাত্র কয়েকবার।
যাঁরা সম্পূর্ণ নির্জনতা পছন্দ করেন, এই দ্বীপটি তাঁদের জন্য এক্কেবারেই পারফেক্ট। কারণ এখানে ঘাসেদের বেড়ে ওঠার শব্দও যেন শোনা যায়। দ্বীপটি পায়ে হেঁটে ট্র্যাকিং করার জন্য উপযুক্ত। সড়ক ব্যবস্থা নেই। তাই গাড়িঘোড়ার কোনও বালাই-ই নেই। দ্বীপটির উপকূল বরাবর মাত্র তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি রাস্তা রয়েছে মাত্র। এই রাস্তার পরই শুধুই উন্মুক্ত সবুজ জমি। সেভেন সিজের এডিনবরার বাইরে এখানে বেশ নিরিবিলিতে সময় কাটানো যায়।
বিবিসি সংবাদ মাধ্যমের ওই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, এদেশের মানুষদের অন্যতম প্রধান জীবিকা চিংড়ি শিকার। সমুদ্রের শীতল জলে ‘ত্রিস্তান লবস্টার’ নামে এক ধরণের বড়ো আকারের সামুদ্রিক চিংড়ি পাওয়া যায়। অধিবাসীরা এই চিংড়ি শিকার করে হিমায়িত করে রাখে। পরে সেগুলি সময় মতো রপ্তানি করে।
তবে অবাক করা ব্যাপার, যে করোনা ভাইরাস সমগ্র পৃথিবীকে উত্তাল করে রেখেছে বিগত কয়েক মাস ধরে, এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু তার প্রভাব পড়েছে অন্য দেশগুলির মতো। কেপটাউন থেকে যে জাহাজগুলি প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে আসে এখানে, করোনা সংক্রমণের কারণে লকডাউন ঘোষণায় সেগুলি এখন আর আসতেই পারছে না। তাই বিপাকে পড়েছেন টিডিসির বাসিন্দারা। শাক-সবজি, ফল-মূল অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে তাঁদের। এখন অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দিকে।