Advertisement
বিজয় ঘোষাল : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরকালই মানুষের অন্তরের কবি হিসাবে নিজের ছাপ রেখে গিয়েছেন। দেশের স্বার্থে ও প্রয়োজনে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন দৃঢ় সংকল্পে। শুধু কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প লিখেই ক্ষান্ত হয়নি, অগ্নিযুগের কঠিন দিনগুলিতে কলম ছেড়ে দৌড়িয়েছেনদেশনেতাদের কাছে। তাড়না দিয়েছেন অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে দীপ্ত কন্ঠে সরব হতে। ব্রিটিশদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে বহুবার গর্জে উঠেছেন তিনি। তীব্র কন্ঠে করেছেন প্রতিবাদ, সমালোচনা। তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ “স্যার” উপাধি ত্যাগ। জালিয়ানওয়ালাবাগে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরব হতে তিনি তাদেরই দেওয়া “স্যার” বা “নাইটহুড” উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কী ছিল এর প্রেক্ষাপট? তারই সন্ধানে এই লেখা…
কবিগুরুকে “নাইটহুড” উপাধিতে ভূষিত :
১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসেন। হার্ডিঞ্জ ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথের “নাইটহুড” প্রাপ্তির পিছনে হার্ডিঞ্জকে ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পর হার্ডিঞ্জের রবীন্দ্রনাথকে জানার আগ্রহ বাড়ে। ১৯১৫ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ইংল্যান্ড সরকারের কাছে প্রস্তাব করেন রবীন্দ্রনাথকে “নাইটহুড”উপাধিতে ভূষিত করার। ৩ জুন ১৯১৫ সালেসম্রাট পঞ্চম জর্জের জম্মদিনে “KNIGHT HOOD” তালিকায় “DR. RABINDRANATH TAGORE OF BOLPUR, BENGAL” বলে ঘোষনা করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যকান্ড :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় রাজনীতিতে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় ব্রিটিশ-বিরোধী ভারতীয় হিংসাত্মক ও জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ রোধ করার উদ্দেশ্যে বিচারপতি সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে জারি করা হয় The Criminal Law Amendment bill। যা আইনে পরিনত হয় ৩ মার্চ, ১৯১৯ সালে। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল দমনমূলক এই আইনের বিরুদ্ধে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার হাজার শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র মানুষ এক প্রতিবাদ সভায় সমবেত হন। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনী অমানবিকভাবে সেই জনতার ওপর গুলিবর্ষন শুরু করে। এই ঘটনায় নিহত হন ৩৭৯ জন এবং আহত হন ১২০০ জন।
রবীন্দ্রনাথের “নাইটহুড” প্রত্যাখান:
পঞ্জাবের এই নৃশংস ঘটনার কথা যাতে বাইরে না প্রকাশ পায়, তার জন্যে ব্রিটিশ সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল। তা স্বত্বেও কিছুদিন পরই গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে ঘটনার ইতিবৃত্তান্ত। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর ২৭ মে আশুতোষ চৌধুরীর মাধ্যমে কবিগুরু জানতে পারেন।
তবে অবাক হতে হয়, গাঁধীজিরনিশ্চুপ থাকা দেখে। রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড্রিউজ সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন গাঁধীজির কাছে। অ্যান্ড্রিউজ সাহেব ফিরে এসে জানিয়েছিলেন, গাঁধীজি এখন পঞ্জাব যেতে রাজি নন। “I do not want to embarrass the Government now”, গাঁধীজির এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াই কবিগুরুও অবাক হয়ে যান।
এরপর কবিগুরু ছুটলেন দেশবন্ধুর কাছে। তাঁকে আবেদন করলেন,পাঞ্জাবের এই ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভা ডাকা হোক। তিনি নিজেই সভাপতিত্ব করবেন। চিত্তরঞ্জন দাশও রাজি হলেন না। কবি ফিরে এলেন।
এরপরেও কিন্তু কবিগুরু চুপ থাকতে পারলেন না। প্রতিবাদপত্র লিখলেন সমকালীন ভাইসরই লর্ড চেমসফোর্ডকে। জানিয়ে দিলেন পাঞ্জাবের অমানুষিক হত্যকান্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি থেকে নিষ্কৃতি প্রদান করুক। এরপর কবির “নাইটহুড” পদত্যাগের সংবাদ ৩ জুন ১৯১৯ সালে The Statesman পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যা পড়ে চমকে উঠেছিল সমগ্র দেশ সহ ব্রিটিশ সরকার।
যদিও রবীন্দ্রনাথের এহেন প্রতিবাদের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়নি তৎকালীন সময়ের কোনওরাজনৈতিক ব্যাক্তির পক্ষ থেকে। এমনকি পট্রভি সীতারামইয়া তাঁর “The History of Indian National Congress” গ্রন্থে সমসাময়িক অনেক কিছু আলোচনা করেছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের এই “নাইটহুড” ত্যাগের বিষয়ে তিনি কোনও কালি খরচ করেননি।
অবশেষে ২৬ জুন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রবীন্দ্রনাথকে ‘‘স্যার’’ উপাধি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ‘‘স্যার’’ হয়েই রয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে ‘‘স্যার’’ উপাধি ব্যবহার থেকে সরে আসেন। স্বদেশবাসীর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর অত্যাচারে কবি মনকে ক্ষোভে, দুঃখে বিচলিত করছিল। কবির একক প্রতিবাদ সেদিন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, তিনি স্বদেশবাসীর কবি, স্বদেশবাসীর বিপদের দিনে তিনিই একমাত্র প্রকৃত প্রতিবাদী।
সূত্র :
১. ‘মর্তের প্রতাপ আর সহ্য হয় না’, অভীক কুমার দে
২. ‘ভারত ও সমকালীন বিশ্ব’, মদনমোহন আচার্য
৩. ‘A Brief History Of Modern India’, রাজীব আহির (Rajib Ahir)
- All Rights Reserved
Advertisement