জাগ্রত নিরিশা কালী মাতার সাতকাহন

Advertisement
Slide1
রেমা মণ্ডল : আমোদপুর জংশন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে অবস্থান করছে রাঢ় বাংলার এই গ্রামনিরিশা গ্রামটি অন্য আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতো হলেও, এর খ্যাতি কালীপুজোর জন্য নিরিশায় আসতে হলে পেরোতে হবে দুধার ঘেঁষা সীমান্ত বিস্তৃত সবুজ ধান ক্ষেত, কয়েকটা রাইসমিল আর বহুকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি সবুজ গ্রামপারগাঁ ও শালগড়িয়া কথিত আছে, আনুমানিক ছশো বছর আগে কোনও এক তান্ত্রিক পঞ্চমুণ্ডির আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে নিরিশায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তিনি প্রথম এই কালীপুজো শুরু করেন তখন অবশ্য গ্রামটি ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ
     বাঙালিদের যেমন শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব, ঠিক তেমনি নিরিশা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ উৎসব নিরিশার কালী পুজো কালীপুজোর প্রায় এক মাস আগে থেকেই সারা গ্রাম জুড়ে সাড়া পড়ে যায় কুড়ি ফুট দীর্ঘ কালী মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয় মূল মন্দির থেকে প্রায় চারশো গজ দূরের আর একটি মন্দিরে (গঠন মন্দির) মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ সামলান কামারডাঙার সূত্রধর পরিবার প্রায় চার পুরুষ ধরে তাঁরাই এই মূর্তি গড়ার কাজ করে আসছেন বংশানুক্রমে মায়ের গঠন বৈচিত্র্য তাঁরা এখনও নিখুঁতভাবে ধরে রেখেছেন
     লাভপুরের কাছে পূর্ণাগ্রামের মালাকাররা নিয়ে আসেন মায়ের ডাকের সাজ পুজোর আগের দিন দেওয়া হয় খড়ি আর পুজোর দিন মাকে সাজিয়ে তোলা হয় তার নিজস্ব রঙে রঙ পর্ব সমাপ্ত হলে ঢাকঢোল, কাঁসরঘণ্টা সহযোগে দেবাংশীদের বাড়ি থেকে আসে মায়ের অলঙ্কার ও পুজোবাড়ির বিশেষ চাঁদমালা তারপর গঠন মন্দিরে মাকে মালা পড়ান রায় পরিবারের কোনও এক প্রবীণ ব্যক্তি এরপর একে একে গ্রামবাসীদের দেওয়া মালা পড়ানো হয় সাজের পর হয় চক্ষুদান সবশেষে কুড়ি ফুট দীর্ঘ এই কালী মূর্তিকে গঠন মন্দির থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মূল কালী মন্দিরে
     এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কীভাবে ছশো বছর আগের সেই তান্ত্রিকের কাছ থেকে কালী পুজোর ভার চলে আসে রায় পরিবারের হাতে? সঠিক উত্তর কি হতে পারে, তা নিয়ে আছে নানান বিতর্ক
     শোনা যায়, আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল আবার অনেকের মতে এই পুজো পাল যুগের এক সময়ে মূল মন্দিরের পশ্চিম দিকে এক নিম গাছের নিচে বেদির ওপর দুই ফুট দীর্ঘ একটি মূর্তি ছিল নির্মাণশৈলী পরীক্ষা করে অনুমান করা হয় সেটি পাল যুগের তবে মূর্তিটি ওখানে কিভাবে এল সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি
     তবে এ এলাকায় কালীপুজো নিয়ে একাধিক জনশ্রুতি আছে তার মধ্যে একটিকোনও এক চৌকিদার গ্রাম পাহারা দেওয়ার সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি আলোর রেখা দেখতে পান সেই আলোর রেখা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতেই এক তান্ত্রিকের সাথে তাঁর দেখা হয় সেই তান্ত্রিকই নাকি তাঁকে এই কালীপুজোর ভার দিতে চেয়েছিলেন তান্ত্রিক নাকি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে, পুজো চলাকালীন সামনে যাকেই দেখবেন তাঁকেই মায়ের পুজোর ভার দিয়ে তীর্থে যাবেন কিন্তু চৌকিদার ছিলেন জাতিতে ডোম তাই তিনি কালীপুজোর ভার নিতে অস্বীকার করেন তখন তিনি সেই পুজোর ভার নিতে অনুরোধ করেন নন্দকিশোর ব্যানার্জীকে
     এবার প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, ব্যানার্জী পরিবার থেকে কীভাবে এই পুজোর ভার গেল রায় পরিবারের হাতে? আসলে সেও এক ইতিহাস
     নন্দকিশোর ব্যানার্জীর ছেলে কেনারাম ব্যানার্জীর কোনও পুত্র সন্তান ছিল না তাই পরে এই পুজোর ভার চলে যায় টুসু মুখার্জী ও নিকু মুখার্জীর হাতে তাঁরা অবিবাহিত থাকায় তাঁদের হাত ঘুরে পুজোর দায়িত্ব চলে যায় গোবিন্দ মোহিনী দেবীর কাছে পরে তাঁর দৌহিত্র সূত্রে এই পুজোর ভার চলে আসে রাখাল রায়ের হাতে যদিও পূর্বে উনাদের পদবি ছিল চ্যাটার্জী, পরে রায় পদবি গ্রহণ করেন বর্তমানে এই রায় পরিবারের হাতেই আছে নিরিশা কালী পুজোর মূল দায়িত্ব প্রায় আড়াইশো বছর ধরে এই রায় পরিবার কালীপুজো করে আসছে
     নিরিশা কালী মায়ের অলৌকিক ঘটনার কথা এখন লোকমুখে বহুল প্রচলিত যদিও সেই সব ঘটনার মধ্যে কিছু রটনাও মিশে আছে তবে এই কালী মায়ের ওষুধের গুণ কিন্তু ভারি বিস্ময়ের অধিকাংশ মানুষই এই ওষুধের ফল পেয়েছেন বিভিন্ন স্ত্রীরোগের অব্যর্থ ওষুধ এখানকার স্বপ্নদত্ত গাছগাছড়া ও জড়িবুটির ওষুধ সারা বছরের প্রতি শনিবার, মঙ্গলবার ও প্রতিমাসের অমাবস্যায় এখানে বহু মানুষের সমাগম ঘটে
     বহু বছর আগে কালীপুজোর পরের দিন বিকালে নিরিশা ও তার পার্শ্ববর্তী চারটি গ্রামের সমদৈর্ঘ্যের কালী প্রতিমাকে নিরিশার শ্মশানে একত্রিত করা হত সেখানে বসত মেলা এখন অবশ্য শ্মশানে আর নিয়ে যাওয়া হয় না পুজোর সাতদিন পর গোধূলিবেলায় বিশাল আড়ম্বরে মন্দির সংলগ্নআমপাল্লাপুকুরে নিরঞ্জন করা হয় তবে নিরঞ্জনের আগে মায়ের শরীর থেকে একটি বাদে আর সবগুলিই গহনা খুলে রাখা হয়
Advertisement
Previous articleকমাতে হবে আলোক দূষণের মাত্রা
Next articleপ্রকাশিত হল শারদ সংখ্যা “আজকের কবিতা”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here