বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে থাকে। বঙ্গদেশে দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর পরই তৃতীয় বড় উৎসব এই জগদ্ধাত্রী পুজো। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস বলছে, এই দুই অঞ্চলের মধ্যে কৃষ্ণনগরেই প্রথম এই পুজোর সূচনা হয়েছিল। আর সূচনা করেছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
দুর্গোৎসব ও কালী পুজো বা দীপাবলির পর বাঙালি এবার মেতে উঠেছে জগদ্ধাত্রী পুজোয়। যদিও এই পুজো দুর্গা বা কালী পুজোর মতো সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে যত্রতত্র হতে দেখা যায় না। নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে বেশ ধুমধামের সঙ্গেই সংঘটিত হয়। এর মধ্যে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর আর হুগলী জেলার চন্দননগরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
জগদ্ধাত্রী কথার আভিধানিক অর্থ জগতের ধাত্রী। অর্থাৎ যিনি এই জগৎ-কে ধারণ করেছেন। একাধিক হিন্দু পুরাণে এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়, তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনী দেবী পার্বতীর দুর্গা বা কালীর মতো অপর একটি শক্তি রূপ। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে তাঁর পুজো হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার মতো দেবী জগদ্ধাত্রীর বাহনও সিংহ।
উপনিষদে দেবী জগদ্ধাত্রী -কে ‘উমা হৈমবতী’ বলা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, একবার অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধে দেবতারা জয়লাভ করেছিলেন। তাঁরা ব্রহ্মের শক্তিতে ছিলেন বলীয়ান। ফলে তাঁদের মধ্যে অপরাজেয়-এর অহংকার বেড়ে যায়। দেবী পার্বতী তখন ছোট্ট এক বালিকার রূপ ধরে তাঁদের কাছে উপস্থিত হয়ে শক্তির পরীক্ষা নিতে চাইলেন। শক্তির পরীক্ষা স্বরূপ একখণ্ড তৃণ ধরলে দেবতারা কেউই সেই তৃণ-কে ভস্মীভূত করতে পারেননি। এই পরীক্ষায় দেবতাদের অহংকার চূর্ণ হয়। দেবতারা সেই ছোট্ট বালিকার আসল পরিচয় জানতে উদগ্রীব হলে দেবী পার্বতী তখন ‘উমা হৈমবতী’ রূপ ধারণ করে তাঁদের ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন।
বলা হয়, বঙ্গদেশে দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর পরই তৃতীয় বড় উৎসব এই জগদ্ধাত্রী পুজো। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস বলছে, এই দুই অঞ্চলের মধ্যে কৃষ্ণনগরেই প্রথম এই পুজোর সূচনা হয়েছিল। আর সূচনা করেছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৭১০ সাল নাগাদ কোনও কারণে একবার দুর্গা পুজোর প্রাক্কালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে তৎকালীন বাংলার নবাব বন্দী করেছিলেন। বন্দীদশা থেকে যেদিন কৃষ্ণচন্দ্র মুক্ত হয়ে নিজের প্রাসাদে ফিরে আসেন, সেদিন ছিল বিজয়া দশমী। ফলে সেবার তিনি দুর্গোৎসবের কোনও আয়োজন করতে পারেননি। পরে স্বপ্নাদেশে তিনি কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে নিজের প্রাসাদে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন। পরে ধাপে ধাপে কৃষ্ণনগর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হতে থাকে।
চন্দননগরে অবশ্য অনেক পরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়েছিল। জানা যায়, চন্দননগরের ফরাসী দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইন্দ্রনারায়ণ একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কৃষ্ণচন্দ্রের আমন্ত্রণে তাঁর প্রাসাদে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোয় মোহিত হয়ে তিনিও চন্দননগরে এই পুজো শুরু করার সংকল্প করেন। পরে চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জের চাউলপট্টির নিচুপটিতে ইন্দ্রনারায়ণ জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন। আজও সেখানে মহাধুমধাম সহকারে এই পুজো হয়ে থাকে। স্থানীয়রা এখন এই পুজোকে ‘আদি জগদ্ধাত্রী পুজো’ বলে থাকেন।