শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রথম দিকের শিক্ষক ছিলেন জগদানন্দ রায়

Advertisement

শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমী। সহজ সরলভাবে শিক্ষাদান ছিল তাঁর সহজাত দক্ষতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদানন্দ রায় এর শিক্ষণ প্রণালীর বিশেষ প্রশংসা করেছেন। জগদানন্দ রায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার প্রয়োজন ছিল এমনসব লোক, যাঁরা সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদের আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলাবাহুল্য, এমন লোক সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক।”


রায়

সুজয় ঘোষাল : শান্তিনিকেতন এর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যে এখন জগত খ্যাত, তাতে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। বছরভর দেশ বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ নিতে আসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যেও যে এত নিবিড় বন্ধন ও ভালোবাসা, তা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা সন্দেহ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই বিশ্বভারতী স্থাপনার প্রথম দিন থেকেই এখানে এই বিষয়ে বিশেষ নজর দিয়ে এসছেন। গুরুর পাঠদান ও শিষ্যের পাঠ গ্রহণের মধ্যে যেন কোনও ফাঁক না থাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নিদ্বির্ধায় ও তার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন রাখতে পারে।

আজ যে শিক্ষকের কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, তিনি জগদানন্দ রায়। ১৮৬৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণনগরের জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও তাঁকে বেশ আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে।

আজকের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদম প্রথম দিকের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিকল্পিত বিদ্যালয়, “ব্রহ্মচর্যাশ্রম”। প্রথমে মাত্র পাঁচজন ছাত্র ও তিনজন শিক্ষক নিয়ে এই বিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হয়। এই তিনজন শিক্ষকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগদানন্দ রায়।

রবীন্দ্রনাথের সাথে জগদানন্দ রায় এর পরিচয় হয়েছিল “সাধনা” পত্রিকার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পাঠকদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্ন রাখা হত এখানে। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করতেন, একজন নিয়মিত সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষার মধ্য দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। পরে জানা গেল, এই সবের উত্তর দেন কৃষ্ণনগরের জগদানন্দ রায়। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শিলাইদহের জমিদারির কাজে নিযুক্ত করলেও পরবর্তী সময়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনের বহ্মবিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন।

ছাত্রদের সঠিকভাবে গড়তে নিরলস পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, অসীম ধৈর্য্য দিয়ে গণিতের সূত্র ও নীরস বিজ্ঞানের যুক্তিগুলিকে সহজে সরস করতে পারতেন তিনি। ছাত্ররা তাঁকে সহজেই ভয় পেত। কিন্তু পরক্ষণেই ছাত্ররা তাঁর ভালোবাসাটাকে বুঝতে পারত। প্রতিদিন সকালে আশ্রমে তিনি ছাত্রদের বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন আর সন্ধ্যায় খোলা আকাশের নীচে ছাত্রদের গ্রহ-নক্ষত্র চেনাতেন।

একবার আশ্রমে ছাত্র-ছাত্রীদের গণিত পরীক্ষা নেওয়া হলে বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী অকৃতকার্য হয়। ক্লাসে তাদের খাতা দেখেই কাঁদতে থাকেন জগদানন্দ রায়। তিনি বুঝতে পারেন ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতে না পারা একজন শিক্ষক হিসাবে তার ব্যর্থতা।

শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে বিজ্ঞানকে বই পাতায় দেখে অভ্যস্ত হয়ে না পড়ে, তার জন্য তারা যাতে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে, সেদিকে সদাজাগ্রত ছিলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রহ-নক্ষত্র চেনাতেন খোলা মাঠে দূরবীণের সাহায্যে। বৃষ্টি কেমনভাবে হয়, বইয়ের পাতায় সেটা বেশ জটিল লাগে পড়ুয়াদের। তাই হাতে-কলমে বোঝালেন তাদের। প্রথমে একটি পাত্রে জল নিয়ে তাপ দিয়ে সেটা বাষ্পে পরিণত করলেন তিনি। এবার বাষ্পটিকে আর একটি পাত্রে ধরে রাখলেন। সবশেষে ঠান্ডা জল ঢেলে সেই বাষ্পটিকে ফের জলে পরিণত করলেন বৃষ্টির মতো করে।

সূর্যের সাদা আলো আসলে যে সাতটি আলোর সমাবেশ তা ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানোর জন্য একটি সাতরঙা চাকতির ব্যবস্থা করলেন তিনি। চাকাটিকে ঘোরানো হল। ঘুরন্ত চাকার মধ্যে বিশেষ কোনও রঙ দেখা গেল না। সব রঙ মিশে ততক্ষণে হয়ে গিয়েছে সাদা। বর্তমানে এই পরীক্ষাগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বেশ সহজ মনে হলেও একশো বছর আগে হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখা ছিল অকল্পনীয়। বিদ্যালয়স্তরে পুঁথিগত বিজ্ঞানের জ্ঞান লাভের পাশাপাশি ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তক ছিলেন জগদানন্দ রায়।

১৯১০ সালের ১৯ মে বাংলার আকাশে হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিলে শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীরা তা প্রত্যক্ষ করেছিল দূরবীণে চোখ রেখে। এই ধূমকেতু ব্যাপারটিকে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝালেন ভালোভাবে।

এইভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনাকে সহজ ও সাবলীলভাবে বোঝানোর জন্য একাধিক বইও রচনা করেছেন জগদানন্দ রায়। “গ্রহ নক্ষত্র”, “বাংলার পাখি”, “প্রকৃতি পরিচয়”, “জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার”, “পোকামাকড়”, “মাছ, ব্যাঙ, সাপঃ, “তাপ”, “নক্ষত্রচেনা”, “চুম্বক” তাঁর রচিত বইগুলির মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও তিনি কল্পবিজ্ঞানের “শুক্র ভ্রমণ” গল্প লিখেছেন। এখানে তিনি মানুষকে অন্য গ্রহে নিয়ে গিয়ে কীভাবে ভিনগ্রহীদের সাথে পরিচয় লাভ করানো যায়, সেকথা সবিস্তারে লিখে গিয়েছে। জগদানন্দ রায় কে তাই অনেকেই বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের পুরোধা বলেছেন।

শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমী। সহজ সরলভাবে শিক্ষাদান ছিল তাঁর সহজাত দক্ষতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদানন্দ রায় এর শিক্ষণ প্রণালীর বিশেষ প্রশংসা করেছেন। জগদানন্দ রায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার প্রয়োজন ছিল এমনসব লোক, যাঁরা সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদের আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলাবাহুল্য, এমন লোক সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক।”

আশ্রমের প্রথমদিকে শিক্ষকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান বোধকে জনপ্রিয় করে তোলেন। শান্তিনিকেতনে বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষা পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন তিনি। শিক্ষাদানে এটটুকু কৃপণতা ছিল না তাঁর। অক্লান্ত চেষ্টা দিয়ে বোঝাতে চায়তেন কাঁচা বয়সী পড়ুয়াদের। এখানেই ছিল তার স্বাভাবজাত মুন্সিয়ানা।

Advertisement
Previous articleপ্রভাত সিং, বছরের পর বছর ধরে মনিষীদের তুলে ধরেন নিজস্ব উদ্যোগে
Next articleতাপমাত্রা : হঠাৎ করে পাঁচ দিনেই কমে গেল ৩০ ডিগ্রী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here