চিরদিনই পুরস্কার বিমুখ ছিলেন বিদ্যাসাগর

Advertisement
উনিশ শতকে ইংরেজদের প্রদত্ত লর্ড, রায়বাহাদুর, রায়সাহেব খেতাব পাওয়ার লোভে সেকালের বড় (?) মানুষেরা কত কি না করতেন। বাবুদের মধ্যে তো এই নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। কিন্তু সে দিক থেকে দেখতে গেলে বিদ্যাসাগর মশাই ছিলেন একদমই ব্যতিক্রমী বাঙালি। শিবনাথ শাস্ত্রীকে একবার বলেছিলেন, “ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যার নাকে চটি জুতা শুদ্ধ পা খানা তুলিয়া টক করিয়া লাথি মারিতে না পারি”। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

Slide1
চিরদিনই পুরস্কার বিমুখ ছিলেন বিদ্যাসাগর 3

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : সারাজীবনে নানা সম্মান এবং পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিদ্যাসাগর মশাই। কিন্তু তিনি নিজে কোনও দিন কোনও পুরস্কারের প্রত্যাশা করেননি। পদক বা পুরস্কারের জন্য উমেদারি করা তো দূরস্থান, বরং তিনি তাঁর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতেন। উনিশ শতকে ইংরেজদের প্রদত্ত লর্ড, রায়বাহাদুর, রায়সাহেব খেতাব পাওয়ার লোভে সেকালের বড় (?) মানুষেরা কত কি না করতেন। বাবুদের মধ্যে তো এই নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। খানাপিনা, বাই নাচ, উপঢৌকন সহ মদের বন্যা বয়ে যেত। ইংরেজ রাজ পুরুষরাও এগুলোকে তাদের স্বাভাবিক প্রাপ্য সম্মান বলেই মনে করতেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বিদ্যাসাগর মশাই ছিলেন একদমই ব্যতিক্রমী বাঙালি। শিবনাথ শাস্ত্রীকে একবার বলেছিলেন, “ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যার নাকে চটি জুতা শুদ্ধ পা খানা তুলিয়া টক করিয়া লাথি মারিতে না পারি”।

তাঁর সাথে উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজপুরুষদের রীতিমতো হৃদ্যতা ছিল। তা বলে কখনওই তিনি তাদের তৈল মর্দনের পক্ষপাতি ছিলেন না। বিদ্যাসাগর মশাই তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কর্মরত, সেই সময় কোনও কোনও সিভিলিয়ান পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে তাদের দেশে ফিরে যেতে হত। এই সবক্ষেত্রে অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেব দয়া করে ওই সমস্ত সম্ভ্রান্ত সিভিলিয়ানদের পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দিতে বললে বিদ্যাসাগর মশাই তা করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, অন্যায় দেখলে কার্য পরিত্যাগ করব। কোনও কারণে সাহেবদের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হলে সেটা নির্দ্বিধায় জানাতে কিংবা পদত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র সময় নিতেন না।

১৮৭৭ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্মেন্ট বিদ্যাসাগর মশাইকে সম্মান জানিয়ে লিখেছিলেন, “ভারত সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামে, রাজ প্রতিনিধি ও গভর্নর জেনারেল বাহাদুরের আদেশে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইকে বিধবা বিবাহ পক্ষীয় দলের অগ্রণী এবং সমাজ সংস্কার প্রিয় হিন্দুগণের পরিচালক বলিয়া এই প্রশংসাপত্র দেওয়া যাইতেছে। স্বাক্ষর–রিচার্ড টেম্পল।

2596
চিরদিনই পুরস্কার বিমুখ ছিলেন বিদ্যাসাগর 4

শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ভারত সরকার বিদ্যাসাগর মশাইকে সি আই ই উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সে যুগে এই উপাধি ছিল অত্যন্ত মর্যাদাজনক। কিন্তু বিদ্যাসাগর মশাই এই উপাধি নিতে অনিচ্ছুক। কারণ এই উপাধি নিতে হলে তাঁকে ধুতি চাদর ছেড়ে দরবারী পোশাক পরে রাজভবনে গিয়ে নতজানু হয়ে উপাধি গ্রহণ করতে হবে। যা এক কথায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে অসম্ভব। তিনি যেমন পুরস্কারের বিড়ম্বনায় পড়তে চান না, তেমনি তাঁর চিরাচরিত পোশাক ধুতি চাদর ছাড়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

তাই ঝামেলা এড়াতে তিনি ঠিক করলেন, দিন কতক কলকাতা থেকে দূরে কারমাটারে গিয়ে থাকাই ভালো। তাহলে চট করে কেউ তাঁর সন্ধান পাবে না। যাইহোক, দরবার চুকেবুকে গেলে কলকাতায় ফিরলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু পুরস্কার তাঁর পিছু ছাড়ল না। তিনি কলকাতায় ফেরার ক’দিন পরেই লাটসাহেবের দপ্তর থেকে একজন পদস্থ কর্মচারী ও একজন চাপরাশি সি আই ই পদক নিয়ে তাঁর বাসায় এসে উপস্থিত হল। অগত্যা বিদ্যাসাগর মশাই পদক গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন।

পদক প্রদান পর্ব মিটে যাওয়ার পরও বিদ্যাসাগর দেখলেন, উক্ত কর্মচারীদ্বয় বকশিশ পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ ইতিপূর্বে তারা যেসব বড় মানুষদের বাড়িতে গেছেন, সেখান থেকেই মোটা রকম বকশিশ পেয়ে এসেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই ও নিশ্চয়ই পদকপ্রাপ্তির খুশিতে তাদের যথোপযুক্ত পারিতোষিক দেবেন, সেই আশায় তারা দাঁড়িয়েছিল।

বিদ্যাসাগর মশাই বুঝতে পারলেন ওদের মনোভাব। তিনি বললেন, “আমি একটা কথা বলি, তাতে আমারও সুবিধে তোমাদেরও সুবিধে। এই পদকখানা নিয়ে বাজারে কোনও বেনের দোকানে গিয়ে বেচে দাও। যা পাবে দু’জনে ভাগ করে নিও।” বলাবাহুল্য কর্মচারী দু’জন এমন আজব লোক বোধহয় জন্মে দেখেনি।

চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে এরকম আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায়। জনৈক ন্যায়রত্ন মশাইয়ের পরামর্শ অনুসারে সরকারি অধ্যাপকদের মধ্য থেকে “মহামহোপাধ্যায়” উপাধি গ্রহণের জন্য বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে একটি প্রস্তাব আসে। বিদ্যাসাগর মশাই অসুস্থতার দোহাই দিয়ে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলেন। জানালেন, “যা চাপানো আছে তা ফিরিয়ে নিলে রক্ষা পাই। এই অসুস্থ অবস্থায় প্রত্যেক দরবারে যেতে পারবো না।” সঙ্গে ডাক্তারের সার্টিফিকেটও পাঠিয়ে দিলেন।

এইসময় সোমপ্রকাশ পত্রিকা ১৮৮৭ সালের ৪ এপ্রিল লিখছে : “পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে জুবিলি উপলক্ষে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দিবার জন্য গভর্ণমের্ন্ট অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাহা লইতে অস্বীকার করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার মনস্বিতার পরিচয় পাওয়া যায় পাওয়া গিয়াছে। এইরূপ আমাদের মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন সাহেবকে উপাধি দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি তাহা লইতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। আমাদের বিবেচনায় মিঃ গ্ল্যাডস্টোন ও পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক প্রকৃতির লোক।”

শিবাপ্রসন্ন লিখেছেন, বিদ্যাসাগর একবার শুনতে পেলেন তাঁর নাম নাকি লাট সাহেবের প্রাইভেট এন্ট্রির তালিকায় ঢুকে গেছে। সে যুগে এই তালিকায় স্থান পাওয়া ছিল মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ তালিকায় নাম থাকলে সেই ব্যক্তি লাট সাহেবের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করার সুযোগ পেতেন। অনেকেই এমন সুযোগ পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন।

সে যাইহোক, লাটসাহেবের সাহেব সেক্রেটারি তো তালিকা নিয়ে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে পরম সৌভাগ্যের খবর জানাতে হাজির হয়েছেন। সেক্রেটারি সাহেব অবশ্য ছিলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধুলোক। বিদ্যাসাগর মশাই তালিকাটা একবার দেখতে চাইলেন। সাহেব ভাবলেন বিদ্যাসাগর হয়তো স্বচক্ষে তালিকাটা দেখে অত্যন্ত খুশি হবেন কিংবা সেই তালিকায় তাঁর কোনও বন্ধু-বান্ধবের নাম সংযুক্ত করার সুপারিশ করবেন। যাইহোক, তালিকা দেখার পর বিদ্যাসাগর মশাই সেক্রেটারীকে বললেন, “আপনি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন।” সেক্রেটারি বললেন, “কথা দিলাম আপনার একটা অনুরোধ রাখব।”

এবার বিদ্যাসাগর সাহেবের হাত থেকে তালিকাটি নিয়ে নিজের নামটি একটানে কেটে দিয়ে বললেন, “আমার অনুরোধ আপনি রাগ করবেন না। কথা দিয়েছেন, অতএব আমার অনুরোধ আপনাকে রাখতেই হবে। আমাকে আর কিছু বলবেন না।” ঘটনা দেখে সাহেব তো হতভম্ব। এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও কেউ হারাতে চায়! অদ্ভুত মানুষ!!

আসলে বিদ্যাসাগর ছিলেন এমন এক অজেয় পৌরুষ, যিনি অন্তর থেকে কোনও কিছুর প্রত্যাশা না করেই অক্ষয় মনুষ্যত্বের সাধনা করে গেছেন।

Advertisement
Previous articleপ্রত্নতান্ত্রিক নিদর্শনেও মিলেছে মা দুর্গার প্রতিচ্ছবি
Next articleলুপ্তপ্রায় কাঠের পালকি ও ঘোড়া নাচের উপকরণ তৈরি নিয়ে বিশেষ কর্মশালা সৃজনীতে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here