Advertisement
‘চাদর বাঁধনী’ পুতুল নাচ সাঁওতালি গ্রাম্য জীবনের এক নিজস্ব ঘরানা শিল্প। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পের কদর ক্রমশই কমতে শুরু করেছে। বিলুপ্তির পথেও এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। তাই এই লোকশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে একটি বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করল শান্তিনিকেতনের পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের সৃজনী শিল্পগ্রাম। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
|
সুজয় ঘোষাল : সাঁওতালি লোকায়ত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ও লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম ‘চাদর বাঁধনী’ পুতুল নাচ। গ্রাম্যজীবনের আরশি হিসাবে এই পুতুল নাচ নানান দিক প্রতিফলিত করতে সক্ষম। গ্রামীণ জীবনের প্রান্তিকস্তরের এই লোকায়ত শিল্প বংশ পরম্পরায় চলে আসা এক অবলম্বন, যার মাধ্যমে এখনও কিছু মানুষ শিকড়ে পৌঁছতে পারেন।
গ্রাম্য সাঁওতালি ভাষায় ‘চাদর বাঁধনী’ পুতুল নাচ সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘চদর বদর’ নামে। আদিবাসী ঘরানার সম্পূর্ণ নিজস্বতায় মোড়া নিজস্ব কৃষ্টি, নিজস্ব নেশা মিশে রয়েছে এই ‘চদর বদর’ পুতুল নাচের মধ্যে। চদর শব্দটির অর্থ চাদর। একপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর ভর করে থাকে একটি বাক্স। সেটারই তিন দিক ঘিরে থাকে চাদরে। শাড়ি দিয়ে মোড়া থাকে বাক্সের নিচের অংশ। আর সেই বাক্সেই ধামসা মাদল সহযোগে নাচতে থাকে সাঁওতালি নারী-পুরুষের প্রতিরূপ সরূপ সারিবদ্ধ পুতুলগুলি।
বীরভূম তথা সাঁওতালি সমাজে এখন ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে এই লোকশিল্পের ধারাটি। এই জেলায় চাদর বাঁধনী শিল্পের দেখা মিলবে ইলামবাজারের গোপালনগর, পাঁড়ুই-এর নিমডাঙা, সাঁইথিয়ার বেনেডাঙা, লাভপুরের সুরাইপুর ও বোলপুরের ব্যাঁকাজল প্রভৃতি গ্রামগুলিতে।
![]() |
‘চাদর বাঁধনী’ পুতুলের বৃহৎ প্রতিরূপ |
গোপালনগরের মাতাল মুরমু এক সময়ে ছিলেন ওই অঞ্চলের নামকরা চাদর বাঁধনী পুতুল শিল্পী। তিনি ও তাঁর দলের শিল্পীরা এই চাদর বাঁধনী পুতুল নাচ প্রদর্শনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল সহ বাইরের অনেক রাজ্যেই গিয়েছেন। নিমডাঙার সকুল মার্ডির চাদর বাঁধনী পুতুল শিল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি স্বল্প দৈঘ্যের তথ্যচিত্র। কিন্তু সেসব কিছু ওই পর্যন্তই। সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে লোক অন্তরালে জায়গা করে নিচ্ছে এই আঙ্গিকটি।
তাই এই লোকশিল্পকে সমাজের বুকে টিকিয়ে রাখতে একটি কর্মশালার আয়োজন করল শান্তিনিকেতনের পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের সৃজনী শিল্পগ্রাম। কর্মশালাটি শুরু হয়েছে গত ৩ জুলাই এবং তা চলবে আগামী ১৮ জুলাই পর্যন্ত। এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছেন ব্যাঁকাজলের চদর বদর শিল্পী সোম মুরমু ও সোম মার্ডি এবং তাঁদের চারজন সহযোগী। তাঁরা জানালেন, এই কর্মশালায় তাঁরা ১২টি চাদর বাঁধনী পুতুল তৈরী করবেন। কর্মশালায় যে পুতুলগুলি তৈরি হবে, তা চাদর বাঁধনী পুতুলেরই বৃহৎ প্রতিরূপ।
![]() |
শিল্পীর হাতে তৈরি হচ্ছে ‘চাদর বাঁধনী’ পুতুল |
সোম মুরমু জানালেন, “এতদিন শান্তিনিকেতনের এত কাছে থেকেও চাদর বাঁধনী পুতুল শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও সহযোগিতা পাইনি। শান্তিনিকেতনের সৃজনী আজ আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এতে আমার সঙ্গে থাকা শিল্পীরা যথেষ্ট উৎসাহ পাবে।” তিনি আরও জানালেন, এককালে প্রতিটা সাঁওতাল গ্রামে চাদর বাঁধনী পুতুল নাচের শিল্পী থাকত। কিন্তু বর্তমানে খুব কম গ্রামেই এই শিল্প আঙ্গিকটি দেখা যায়।
সৃজনী শিল্প গ্রামের আধিকারিক অমিত অধিকারী জানালেন, গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকশিল্পগুলি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে নিছকই প্রচারের অভাবে। চাদর বাঁধনী পুতুল শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। তাই সাঁওতালি ঘরানার এই পুতুল শিল্পকর্মকে লোকমানসে ফিরিয়ে আনার জন্যই এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মশালার সমাপ্তিতে পুতুলগুলি সংগ্রহ করে রাখা হবে সৃজনী শিল্পগ্রামে-ই।
Advertisement