ঘাটোয়ালরা আজও কোনও রকমে টিকে রয়েছে আমোদপুরের বুকে

Advertisement
আমোদপুরের সঙ্গে ঘাটোয়াল যোগ কীভাবে ঘটেছে তা এক রহস্যের বটে। আমোদপুর রেলস্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০-৪০টি পরিবার আজও বসবাস করছে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। শিক্ষা আজও তেমনভাবে প্রবেশ করতে পারেনি এঁদের মধ্যে।
ঘাটোয়ালরা আজও কোনও রকমে টিকে রয়েছে আমোদপুরের বুকে
সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : প্রাচীন বাংলা জনজাতির ইতিহাস ঘাটলে ঘটোয়াল সম্প্রদায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। বীরভূম বরাবরই শুষ্ক প্রকৃতির ছিল না। প্রাচীন বীরভূম ছিল বেশ শস্য-শ্যামলা। তাই বীরভূমে জনপদ স্থাপনে পাহাড়িয়া যুদ্ধপ্রিয় জনজাতি ও বহিঃ আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তৎকালীন বীরভূমের রাজধানী রাজনগরকে বহিঃ আক্রমণ ও বর্গীদের থেকে সুরক্ষা করার জন্য এর ৩২ মাইল এলাকা জুড়ে মাটির প্রাচীর এবং চারপাশে খাল বা পরিখা (গড়) কাটা হয়েছিল। এই পরিখাগুলিকে ঘাট বলা হত। ঘাটগুলি রক্ষা করার জন্য কিছু সীমান্তরক্ষী সশস্ত্র চৌকিদার নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের বলা হত ঘাটরক্ষী বা ঘটোয়াল।
     অনেক সময় কোনও অঞ্চলের জমিদার ঘাট বা জলাশয় পাহারা দিতেও এদের নিয়োগ করতেন। বর্তমানে বীরভূমের রাজনগর ছাড়াও এই জেলার আমোদপুর অঞ্চলে রেলস্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে আজও বেশ কিছু ঘটোয়াল সম্প্রদায়ের পরিবার বসবাস করেন। রেলস্টেশনের এই পাড়াটি তাই ঘটোয়াল পাড়া নামে পরিচিত।
আমোদপুরের সঙ্গে ঘটোয়াল যোগ :
     ১৭৪১-১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে বর্গীরা টানা দশ বছর বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ ও লুঠতরাজ চালিয়েছিল। অনুমান করা হয়, তৎকালীন রাজনগরের দেওয়ান বদিউলজমার দুই পুত্র আহাম্মদ উলজমা খাঁ ও আলিনকী খাঁ বর্গী বিতারণে ঘাটরক্ষীদের ব্যবহার করেছিলেন। ওই ঘাটরক্ষী বা ঘাটোয়ালদের নিয়ে গঠন করেছিলেন একটি লাঠিয়াল বাহিনী। বর্গী বিতাড়ন করতে আহাম্মদ উলজমা খাঁ বর্তমানের আমোদপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। তখন তিনি এই জায়গাটিতে একটি নতুন নগরের পত্তন করেন। নাম দেন আহম্মদনগর। এই আহম্মদনগর পরে কালক্রমে অপভ্রংশ হয়ে বর্তমানে আমোদপুর নামে পরিচিত হয়েছে। বর্গী আক্রমণ প্রতিহত হলে অন্য সকলে রাজনগর ফিরে গেলেও কিছু ঘাটোয়াল তখনও রয়ে যায় আমোদপুর ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে।
     আরও একটি সূত্র বলছে, আমোদপুরের পাশ্ববর্তী সিউর গ্রামের শেষ রাজা গুরুদাস সিংহের সময়ে এই অঞ্চলে মারাঠা বর্গী আক্রমণের পূর্বভাস ছিল জোরালো। তাই নগর সুরক্ষিত করতে সিউর গ্রামে পরিখা বা খাল কাটা করা হয়েছিল। সে সময়ে রাজা গুরুদাস কিছু ঘটোয়ালকে নিয়ে এসে লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেছিলেন। ঘাটোয়ালরা তখন ওই পরিখা বা খাল পাহারা দিত। এরপর বর্গী আক্রমণ শেষে ধীরে ধীরে ঘাট প্রহরীদের গুরুত্ব কমে যায়।
     সেসময়ে যোগাযোগের জন্য জলপথের গুরুত্ব ছিল অনেক। আমোদপুরের খুব কাছেই বক্রশ্বর নদীর কিনারে টেকোড্ডা ঘাট ছিল। লোক পারাপারের জন্য এখানে অর্থও আদায় করা হত। পরে এই ঘাট পাহারার কাজে ঘাটোয়ালদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
     তবে আমোদপুরের বর্তমান ঘটোয়াল সম্প্রদায়ের মানুষদের দাবি, তাঁদের পূর্বপুরুষ বিহারের দুমকা অঞ্চল থেকে এখানে এসেছেন। ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি বর্ধমান-সাহেবগঞ্জ লাইনের রেলপথ নির্মাণের কাজে সহযোগিতার জন্য ঘাটোয়ালদের এই আমোদপুরে নিয়ে আসে। রেলপথ স্থাপনের পরেও তারা আমোদপুর রেলগুদামে পাহারাদার হিসাবে নিযুক্ত ছিল। পরে ব্রিটিশরা চলে যাওয়া পর তারা আর দুমকা ফিরে যায়নি। পাকাপাকিভাবে আমোদপুরেই থেকে গিয়েছে।
     যাইহোক, আমোদপুরের সঙ্গে ঘাটোয়াল যোগ এখনও এক রহস্যময় ব্যাপার। এর সমাধান আজও স্পষ্ট করে করা সম্ভব হয়নি।

ঘাটোয়ালরা আজও কোনও রকমে টিকে রয়েছে আমোদপুরের বুকে
আমোদপুর রেলস্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে আজও বসবাস করছে ঘাটোয়াল সম্প্রদায়

বর্তমান বাসস্থান ও জীবনযাপন :
     আমোদপুর রেলস্টেশনের বাইরে মোট ৩০-৪০টি ঘাটোয়াল পরিবার এখন বসবাস করছেন। এরা অধিকাংশই তপশীলি জাতির অন্তর্ভুক্ত। পদবী রায়। অধিকাংশের বাসস্থানই মাটির। বাঁশ, কঞ্চি, খড় দিয়ে ছওয়ানো হয়েছে ঘরের চাল। কোনও ঘর আবার খড়ের ওপর ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। কারও বা আ্যসবেষ্টারের ছাওনি। বর্ষাকালে প্রচণ্ড অসুবিধা ভোগ করতে এঁদের। পথে জল জমে কাদা হয়।
জীবিকা ও  অর্থনৈতিক জীবন :
     বর্তমানে ঘটোয়ালদের পেশাগত পরিবর্তন এসেছে। এই সম্প্রদায়ের পুরুষেরা এখন কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ কুলিগিরির কাজ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া অনেকে ভিনরাজ্যেও চলে গিয়েছেন পেটের দায়ে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যায় বেশি। মহিলারা অন্যের বাড়িতে পরিচায়িকার কাজ বেছে নিয়েছেন। কোনও কোনও মহিলা একই দিনে ৪-৫টি পর্যন্ত বাড়ির পরিচায়িকার কাজ করে থাকেন। বাড়ি পিছু মাসিক আয় গড়ে ১০০০ টাকা। মহিলাদের অনেকেই আবার স্বনির্ভর দলের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

ঘাটোয়ালরা আজও কোনও রকমে টিকে রয়েছে আমোদপুরের বুকে
ঘাটোয়াল সম্প্রদায়ের জনজীবন

শিক্ষা :
     অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকার জন্য বরাবরই এঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা মোটেও আশানরূপ নয়। তবে বর্তমানে এঁদের মধ্যে শিক্ষা কিছুটা প্রবেশ করতে পেরেছে। প্রাথমিক স্কুল সমাপ্তির পর উচ্চ শিক্ষার জন্য হাইস্কুলেও অনেকে ভর্তি হচ্ছে। তবে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্তই এঁদের সীমানা। তারপরই অর্থের পিছনে দৌড়োতে পড়াশুনায় ইতি টানতে হচ্ছে। এঁদের অনেক ছেলে-মেয়ে সামান্য পড়াশুনার পরই বহুরূপীর সাজে নেমে পড়ছে। তবে বর্তমানে কন্যাশ্রী ও সুবজসাথীর জন্য মেয়েরা স্কুলমুখী হচ্ছে ক্রমশ।
উৎসব :
     আমোদপুরের ঘটোয়াল সম্প্রদায়ের সর্বপেক্ষা জনপ্রিয় উৎসব কালীপুজো। এই কালীপুজো লোকমুখে ‘বুড়িমাকালী’ নামে পরিচিত। পুজোর প্রায় একমাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয় ঘরে ঘরে। পুজোর সময় তাস খেলা, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যেমন যাত্রাগান, আলকাপ ও স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। কালীপুজো ছাড়াও ছটপুজোও এঁদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
বর্তমান সমস্যা ও সমাধানের উপায় :
     বর্তমানে বেশকিছু ঘাটোয়াল সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হলেও অধিকাংশই আজও পড়ে রয়েছে অন্ধকারে। দারিদ্রতা ও অতি-দারিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাঁদের। অভাব এদের নিত্যসঙ্গী। এই অভাবের প্রথম কারণ সামাজিক কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, সামাজিক বন্ধনে দৃঢ়তা না থাকা ও শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা। তৃতীয়ত, মাদকাশক্তি ও নেশার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে না রাখা। চতুর্থত, সরকারী ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও নিজেদের অধিকার অজ্ঞাত থাকা।
     তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকার জন্য ঘাটোয়াল জনজাতিকে এককভাবে দোষারোপ করা মোটেও সমীচীন নয়। কারণ তাঁদের ন্যায্য অধিকার তাঁরা কোনও দিনই পাননি। সমাজ তাঁদেরকে বঞ্চিত করেছে বিভিন্নভাবে। শুধু প্রশাসন নয়, সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী মধ্যবিত্ত, উচ্চবর্ণের মানুষ এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে এদের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম এদের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও জীবিকার জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে পাশে দাঁড়ালে, এই প্রান্তিক ঘটোয়াল সম্প্রদায়ের মানুষ নিশ্চয় সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন।
তথ্যঋণ :
১. সীমান্ত বাঙলার লোকযান, সুধীরকুমার করণ।
২. স্বদেশচর্চা লোক, গোষ্ঠী সমাজ সম্প্রদায়, সম্পাদক প্রণব সরকার।
Advertisement
Previous articleসন্ধান পাওয়া গেল সবচেয়ে প্রাচীন স্থলচর প্রাণীটির
Next articleপৃথিবীর ধার ঘেঁষে পেরিয়ে যাবে উল্কাপিণ্ড, ভয়ের কোনও কারণ নেই জানালো নাসা

2 COMMENTS

  1. আহম্মদ জমা খাঁ ঘাটোয়ালদের সহায়তায় বর্গী বিতাড়ন ও আহম্মদপুরের স্থাপন বিষয়ে তথ‍্যসূত্রের ডিটেলে উল্লেখ করলে ভাল হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here