একটা সময় ছিল, যখন আমোদপুরের প্রধান উৎসব বলতে এই চড়ক-কেই বোঝানো হত। চড়কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে একটি ছোট্ট গ্রামীণ মেলাও বসত এই হাটতলায়। থাকত পাঁপড়ভাজা, তালপাতার পাখা, নানা ধরণের সুস্বাদু মিষ্টি, খেলানার দোকান প্রভৃতি। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসত ভিড় করে। এমনকি স্থানীয় জমিদার বাড়ির মানুষেরাও এই চড়কে সামিল হতে এগিয়ে আসত। সেসময়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ঘুরত ‘চড়ক ঘোরা’। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সুজয় ঘোষাল ও বিশ্বজিৎ ঘোষ : বাংলা ক্যালেন্ডারের একেবারেই শেষ উৎসব গাজন। প্রতি বছর একই দিনে ও প্রায় একই সময়ে আয়োজন করা হয় এই উৎসবের। এর জন্য প্রয়োজন হয় না কোনও তিথি-নক্ষত্রেরও। মূলত শিবের পুজোকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হওয়া এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে চড়কের মাধ্যমে। গাজনের শেষ অনুষ্ঠান তাই চড়ক। বাংলা ও বাঙালির তের পার্বণের শেষ পার্বণ এই গাজন বা চড়ক।
বীরভূম জেলার আমোদপুর এককালে ‘চিনির কল’ বা ‘সুগার মিল’-এর জন্য বিশেষ পরিচিত ছিল। যদিও সেসবের পাঠ কয়েক দশক আগেই উঠে গিয়েছে। তাই বলে বীরভূমের বুকে আমোদপুরের গুরুত্ব এখনও কোনও অংশে কমেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থার অতি সরলীকরণে আমোদপুর আজও বীরভূমের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল।
একাধিক বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় এই অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসবের দিকেও। যার মধ্যে একটি অবশ্যই বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ উৎসব ‘গাজন’। এই অঞ্চলের মণ্ডলপাড়ার প্রাচীন এক শিব মন্দির (বুড়ো শিব) প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এই গাজন উৎসব। এই উৎসবের বয়স আনুমানিক ৫০০ বছরেরও বেশি।
গাজন অবশ্যই গ্রামীণ উৎসব। তবে জনসংখ্যার তারতম্য ও নগর সভ্যতার ছাপ আমোদপুরকে ক্রমশ শহরে রূপান্তরিত করলেও বর্ষ শেষের গাজন উৎসব আজও গ্রামীণ জনজীবনের বৈশিষ্ট্য জাগিয়ে রেখেছে। এখানে সামিল হতে এগিয়ে আসেন মণ্ডলপাড়া ও দাসপাড়ার একাধিক ‘ভক্ত’। হাতে থাকে বেতের পাকানো লাঠি। মূলত শারীরিক কৃচ্ছসাধন, নিষ্ঠা ও তাঁদের দৈহিক সংযম উৎসবকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দেয়।
শিবভক্তির নিদর্শন হিসাবে এইসব ভক্তরা উৎসবের বিভিন্ন সময়ে ফুলখেলা, বাণফোঁড়া, আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে নিজেদের ভক্তি উজার করে দেয়। এখানে গাজন শুরু হয় বাণেশ্বর শিবের পরিক্রমার মাধ্যমে। বাণেশ্বর শিবের কাঠের পাটাতনের ওপর পেরেকের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া হয় একটি আম। একজন ভক্ত সেই আমের উপরেই নিজেকে শুইয়ে দেয়। তারপর ভক্ত সহ সেই পাটাতনটি পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যায় অন্য ভক্তরা। এরপর ভক্তরা একে একে মন্দির চত্বরে এসে শুরু করে শিবের গান আর সেই সঙ্গে ঘোরাতে থাকে হাতে থাকা বেতের লাঠি।
দ্বিতীয় দিন ভক্তদের প্রায় গোটা রাত জেগে থাকতে হয়। ভক্তদের জাগিয়ে রাখতে এই সময় বোলান গানের আয়োজন করা হয়। পূর্বে জেলার বিভিন্ন প্রাঙ্গণ থেকে এখানে বোলান গানের দল আসত। চলত গানের প্রতিযোগিতা।
যাইহোক, বোলান গানের শেষে শুরু হয় নাগরা খেলা। নাগারা খেলা মূলত কাঁটাঝাপের রূপভেদ। এখানে বাবলা গাছের ডাল সারি করে সাজিয়ে ভক্তরা গড়াগড়ি দেয়। শেষ রাত্রিতে চলে ফুলখেলা। খড় সহ নানান জ্বালানি নিয়ে একটা স্তূপ বানিয়ে আগুন ধরানো হয়। আগুন নিভে গেলে ভক্তরা আগুনঝাঁপ শুরু করে।
পরের দিন সকালবেলাতেই ভক্তরা বেরিয়ে পরে স্থানীয় শ্মশানে ‘মড়ার মাথা’ সংগ্রহ করতে। বিকালে আরম্ভ হয় বিশেষ হোম উৎসব ও নীল পুজো। হোমের শেষে হয় বাণফোঁড়া। প্রায় ১১ হাত বাণ জিভে ফোঁড়েন ভক্তরা। এখানে বাণ ফোঁড়া হয় পূণ্য সঞ্চার তথা শিবলোক প্রাপ্তির আশায়। নিজেদের ইষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করেন ভক্তেরা।
এরপর শুরু হয় চড়ক পুজো। এটিই গাজনের শেষ অনুষ্ঠান। পূর্বের চড়ক কাঠ-টি ছিল তেঁতুল কাঠের। সেটিকে পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হত। নির্দিষ্ট দিনে তুলে আনত ভক্তরা। তবে বছর পাঁচেক হল তেঁতুল কাঠের পরিবর্তে নিমে কাঠে চড়ক পালন করা হয় এখানে। এখন আর পুকুরেও ডুবিয়ে রাখা হয় না সেটিকে।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবলু মণ্ডল ও মিহির দত্ত জানালেন, এখানকার চড়ক বরাবরই হাটতলা প্রাঙ্গণেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এখানে হাট বা বাজার বসত। ঘন বসতির চাপে এখন সমগ্র বাজারটিকেই আমোদপুর স্টেশন সংলগ্ন স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন আমোদপুরের প্রধান উৎসব বলতে এই চড়ক-কেই বোঝানো হত। চড়কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে একটি ছোট্ট গ্রামীণ মেলাও বসত এই হাটতলায়। থাকত পাঁপড়ভাজা, তালপাতার পাখা, নানা ধরণের সুস্বাদু মিষ্টি, খেলানার দোকান প্রভৃতি। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসত ভিড় করে। এমনকি স্থানীয় জমিদার বাড়ির মানুষেরাও এই চড়কে সামিল হতে এগিয়ে আসত। সেসময়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ঘুরত ‘চড়ক ঘোরা’।
তবে দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সেসব অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। চড়ক পূর্বের তুলনায় অনেক ছোটো হয়েছে। তবে আজও আকর্ষণ রয়েছে ষোলআনা।
চড়কের সঙ্গে বরাবরই সঙ সাজার একটা সম্পর্ক রয়েছে। অনেকেই সঙ সাজেন চড়কের উৎসবে। পূর্বে সঙ সেজে এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে চাল সংগ্রহ করত সঙেরা। সংগৃহীত চাল বিক্রি করে চড়ক মেলার খরচ যোগাত তারা। এখন সঙ সাজা হয় শুধুমাত্র মনোরঞ্জনের জন্য। সেই সঙ্গে কমেছে সঙ সাজার মানুষের সংখ্যাও।
যাইহোক, চড়কের দিন ভক্তরা চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে রাখেন। চড়ক শুরু হয় সন্ধ্যা নাগাদ। জনসমাগমে ভরে ওঠে গোটা হাটতলা চত্বর। ভক্তরা শোভাযাত্রা সহকারে দলে দলে প্রবেশ করেন চড়কতলায়। তারপর চড়কগাছের নীচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শিবপাঁচালী ও লৌকিক ছড়া উচ্চারণ করে সুর করেন। এরপর শুরু হয় ‘চড়ক ঘোরা’।
পূর্বে ইলেকট্রিসিটির অভাবে বিকেলের মিঠে আলোয় চড়ক ঘুরত। এখন তার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। তবুও আমোদপুরের এই একদিনের চড়ক হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সত্তার ক্ষুদ্র অবয়বটিকে কিছুক্ষণের জন্য নাগরিক সভ্যতার অট্টালিকার ভিড়ে তুলে ধরে নিখুঁতভাবে।