‘গ্রহণ’ চলাকালে খাওয়া চলবে না, ব্যাপারটি একেবারেই গ্রাহ্য নয়

Advertisement
সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় সেকালের বাছ-বিচারের কিছুটা অংশ আজও রয়ে গিয়েছে বর্তমান সভ্য সমাজের গভীরে। উচ্চ শিক্ষিত সমাজের একাংশ গ্রহণ চলাকালে খাদ্যদ্রব্যকে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে চলতে চায়। অথচ তাদের দেখানো যুক্তি তারা নিজেরাই পরখ দেখে না, সেটি কতটা যুক্তিযুক্ত। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

‘গ্রহণ’ চলাকালে খাওয়া চলবে না, ব্যাপারটি একেবারেই গ্রাহ্য নয়
বোলপুর-শান্তিনিকেতনে টেলিস্কোপের সাহায্যে সূর্যগ্রহণ দেখানোর প্রচেষ্টা

সজয় পাল : সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ-এর প্রকৃত কারণ এখন কারও-ই অজানা নেই। পৌরাণিক যুগের রাহু-কেতুর ঘটনা ছেড়ে বেশ অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে এখনকার শিক্ষিত সমাজ। যদিও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে কেউ-ই তেমন মাথা ব্যথা দেখায় না। কারণ চতুর্দিকে হাজারো বাতির ঝলমলিয়ে ওঠা রাতের অন্ধকারে রোম্যান্টিক কবি ছাড়া এই যুগে তেমন কেউ আর চাঁদের দিকে চেয়ে থাকার ফুসরত পায় না। কিন্তু সূর্যগ্রহণ নিয়ে আগ্রহ এখনও তুঙ্গে। মধ্য দুপুরে ধীরে ধীরে সূর্যের মিলিয়ে যাওয়ার মতো মহাজাগতিক ঘটনা আর কি-ই বা হতে পারে!
     যাইহোক, একথা সত্য যে পৌরাণিক যুগের রাহু-কেতু এখন আর গ্রাস করে না সূর্যকে। তার জায়গায় অমাবস্যার দিনে সূর্যকে ঢেকে দেয় চাঁদ। কিন্তু গ্রহণের দিনে সেকালের বাছ-বিচারের কিছুটা লেজুর আজও অবলীলায় পালন করে চলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষেরা। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিককালের কিছু অপ্রাসঙ্গিক যুক্তিও। যে যুক্তির কাছে বিনা বাক্যে মাথা নামিয়ে নিয়েছে উচ্চ শিক্ষিত সমাজও।
     ঘটনাক্রমে মনে পড়ে যায়, গত শতাব্দীর নব্বই-এর দশকের পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বইয়ের কথা। সেখানে মহান বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘সত্য ও অসত্য’ নামের একটি গদ্যাংশ ছিল। গদ্যাংশটিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ছাত্ররা গ্রহণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে পড়ল, জানলো এবং পরীক্ষায় তা উল্লেখ করে নাম্বারও পেল। কিন্তু গ্রহণের সময় সেই পূর্বের মতো ঢোল, করতাল, শঙ্খ সহযোগে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
     যদিও এযুগে গ্রহণের সময় ঢোল, করতাল সহযোগে কাউকে আর রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে দেখা যায় না। কিন্তু গ্রহণ লাগার মুহূর্তে কিছু বাড়ি থেকে আজও শঙ্খ ধ্বনি ঠিকই শুনতে পাওয়া যায়। এ যেন কোনও এক যুদ্ধ শুরুর অগ্রিম মুহূর্ত।
     খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অবশ্য সবচেয়ে বেশি হিসাবী এই সভ্য সমাজ। গ্রাম বা শহর উভয় ক্ষেত্রেই আজও গ্রহণ চলাকালে (সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে) এক শ্রেণীর মানুষ, এমনকি তার মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও খাদ্যদ্রব্য গ্রহণকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। বিজ্ঞানের ছাত্ররা আবার আর এক ধাপ এগিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত করে জীবাণু বা ভাইরাস আক্রান্তের এক গুচ্ছ যুক্তিকে। তাদের কথায়, সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের আলো ও তাপ বা তেজ কিছু সময়ের জন্য কমে যায়। ফলে পরিবেশে ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাসের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই সময়ে কোনও কিছু খাওয়া একেবারেই অনুচিত। তাই খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না।
     আপাতভাবে দেখলে তাদের এই যুক্তি একেবারেই ফেলে দেওয়ার নয়। সূর্যের আলো ও তাপের অনুপস্থিতিতে ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাস বাড়তেই পারে। এটা স্বাভাবিক। তাহলে রাতের অন্ধকার কি দোষ করল? রাতেরবেলা প্রায় ১২ ঘণ্টা (বছরের গড় হিসাব) জুড়ে সূর্যের টিকিটিরও দেখা মেলে না। জীবাণু বা ভাইরাসের জন্ম তখনও হতে পারে। সেসময়ে খাদ্য গ্রহণে বাধা আসে না কেন? তাদের কাছে এই প্রশ্নের যুক্তিও প্রায় সঞ্চিত। এখানে তারা যুক্তি দিচ্ছে, রাতের বেলা পৃথিবীর এক পিঠে সূর্যের দেখা না মিললেও ওপর পিঠে সূর্য উপস্থিত থাকে। সেখানে আলো ও তাপ উভয়ই পাওয়া যায়। এতে অন্ধকার অংশে তেমন সমস্যা হয় না। আসলে এই যুক্তিও ঠিক অনেকটা বাতের ব্যথায় গলায় মাদুলি ঝোলানোর মতো।
     শিক্ষিত সমাজের যুক্তি কখনওই থেমে থাকতে চায় না। সে শুধু চলতে চায়। গ্রহণের সময় হাজারো যুক্তি দাঁড় করিয়ে খাওয়া-টাকে আটকানোই তার একমাত্র লক্ষ্য। সে কখনও ভেবেও দেখে না ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাসের জন্ম উপযুক্ত পরিবেশে যে কোনও সময়ই হতে পারে। সূর্যের উপস্থিতিতে যদিও তার জন্মের হার অনেকটাই কম। কিন্তু গ্রহণের সময় এই যুক্তি একেবারেই খাটে না।
     মনে রাখা দরকার, সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর সব স্থানে একই সময়ে শুরু বা শেষ হয় না। অথবা সব স্থানে একই সময়ে ঘটে না। আবার সব স্থানে সমানভাবে গ্রহণের দেখা মিলবে তারও কোনও কথা নেই। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২১ জুন যে সূর্যগ্রহণের দেখা মিলেছিল তা ছিল আংশিক। অর্থাৎ এক্ষেত্রে চাঁদ সূর্যের কিছুটা অংশ (৭০ শতাংশ) ঢেকে দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের অপর প্রান্ত ‘যোশীমঠ’ থেকে সূর্যের সম্পূর্ণ বলয়গ্রাস-কেই দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ কোথাও না কোথাও সূর্যের উপস্থিতি অবশ্যই থাকবে। তাই গ্রহণের সময়ে জীবাণু বা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে খাওয়া যাবে না, এই যুক্তি একেবারেই গ্রাহ্য নয়।
Advertisement
Previous article‘ওউমুয়ামুয়া’ কি এলিয়েনদের মহাকাশযান, নাকি অন্য কিছু !!
Next articleসুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও ইতিহাসের আলোয় জগন্নাথের রথযাত্রা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here