জাতীয় মহিলা কমিশনের একটি রির্পোট বলছে, এদেশে লকডাউন চলাকালে যতগুলি গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা ঘটেছে, লকডাউন শিথিল হওয়ার পরবর্তী সময়ে ঘটেছে তার থেকেও প্রায় ৮৬ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত জাতীয় মহিলা কমিশন গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ পেয়েছে ১৪৭৭টি। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকেও অনেক বেশি। কারণ গার্হস্থ্য হিংসার বহু ঘটনা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে থানা বা মহিলা কমিশন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। |

বিদিশা মিত্র : বর্তমানে গার্হস্থ্য হিংসা একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই হিংসায় একজন নারীর জীবনই যে শুধু অন্ধকারে ঢেকে যায় তা নয়, পারিবারিক সুস্থ পরিবেশও সহজেই অসুস্থ হয়ে ওঠে। আর সেই অসুস্থ পরিবেশ যে কোনও শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কর জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলতে যথেষ্ট।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অপরাধ প্রবনতা গড়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণই হল এই গার্হস্থ্য হিংসার পরিবেশ। গার্হস্থ্য হিংসার কবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুর মানসিক বিকাশ ও স্বাভাবিক চেতনা। বাড়ির যে কোনও নেতিবাচক ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলে শিশু মনে। তাই শিশুর মন যত বেশি গার্হস্থ্য হিংসা ও পারিবারিক সমস্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে, তার মনোবৃত্তিও তত বেশি অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির কারণে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রায়। কর্মহীন হয়েছেন বহু মানুষ। এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে মানসিক চাপ। যার ফলে গার্হস্থ্য হিংসা ও পারিবারিক সমস্যার বৃদ্ধির হার এখন চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে কিছু ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে প্রকাশ পায় ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। যার মধ্যে বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে।
‘হু’ অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization)-র পরিসংখ্যান বলছে, সারা পৃথিবীতে গড়ে প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে একজন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন। আবার ভারতে এই সংখ্যা একটু বেশি। এখানে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি করে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়।
জাতীয় মহিলা কমিশনের একটি রির্পোট বলছে, এদেশে লকডাউন চলাকালে যতগুলি গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা ঘটেছে, লকডাউন শিথিল হওয়ার পরবর্তী সময়ে ঘটেছে তার থেকেও প্রায় ৮৬ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত জাতীয় মহিলা কমিশন গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ পেয়েছে ১৪৭৭টি। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকেও অনেক বেশি। কারণ গার্হস্থ্য হিংসার বহু ঘটনা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে থানা বা মহিলা কমিশন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
যদিও এই সমস্যা আজকের নয়, বহু যুগ ধরেই চলে আসছে। এর সমাধান হেতু আইনি পথও তৈরি রেখেছে ভারতীয় সংবিধান। কিন্তু সেই পথের সন্ধান কতজন নির্যাতিতা নারী খুঁজে পাচ্ছেন, তাও সন্দেহ রয়েছে।
গার্হস্থ্য হিংসার অন্যতম একটি খারাপ দিক অবশ্যই বৈবাহিক ধর্ষন (marital rape)। অথচ অবাক করা বিষয়, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা ‘বৈবাহিক ধর্ষন’ নামের কোনও শব্দকে প্রাধান্য দিতে চায় না। গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন, ২০০৫ অনুযায়ী, একজন নারী সমাজে তিন ধরণের অধিকার ভোগ করতে পারেন। প্রথমত সুরক্ষা, দ্বিতীয়ত শ্লীলতাহানির বিরুদ্বতা এবং তৃতীয়ত সংশ্লিষ্ট বাড়ির অংশীদারিত্ব ভিত্তিতে বসবাসের অধিকার। নারীর শারীরিক, মানসিক, যৌন নিগ্রহ এসবই আসবে এই আইনের আওতায়।
তবে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গ্রামাঞ্চলের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে ওই সমস্ত সংস্থার যোগাযোগ ক্রমশ তৈরি হচ্ছে। এই ব্যবস্থা আরও দ্রুত ও সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিত করতে পারলে গার্হস্থ্য হিংসার থেকে নারীদের মুক্তি পাওয়ার পথ আরও সহজ হয়ে উঠবে।