গাঁধী পুণ্যাহ – একটি জীবন বোধের প্রতীক

Advertisement
m05FRGANDHI2258
অতনু কুমার সিংহ : ১০ মার্চ শান্তিনিকেতন আশ্রমে একটি পুণ্য দিন – এই দিনটি মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দান করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের শুভাকাঙ্ক্ষী, সুহৃদয় ছিলেন তিনি। গাঁধীজি রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতেন, পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘মহাত্মাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য হেতু ইংরেজ-বুয়ব শাসকগণ ভারতীয়দের উপর যে সকল আইন প্রয়োগ করেন তা অমান্য করার জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গাঁধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয়। মাধ্যম ছিলেন একজন ব্রিটিশ, সি.এফ. এন্ডরুজ। ১৯১৪ সালে এই আন্দোলনের নিষ্পত্তি হলে গাঁধীজি ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে ফিনিকস্ বিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রদের শান্তিনিকেতনে পাঠান। এই ছাত্ররা খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন, নিরামিষ খেতেন এবং রান্না-বান্না, কালকাচা, জলতোলা, ঝাঁট দেওয়া, পায়খানা পরিষ্কার সবই নিজেরাই করতেন।
     এক বছর পর (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫) গাঁধীজি তাঁর স্ত্রী কস্তুরীবাঈকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায়। পরের দিন (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫) গোপালকৃষ্ণ গোখলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গাঁধীজি সস্ত্রীক পুনা চলে যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এলেও উভয়ের সাক্ষাৎ হয়নি। শান্তিনিকেতনে উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ ওই বছর ৬ মার্চ। এরপর গাঁধীজি কখনও শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোদ্যোগ পর্ব বা শিক্ষাসত্র পরিদর্শনে আসেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে গাঁধীজি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলে রবীন্দ্রনাথ আম্রকুঞ্জে নিজহাতে গাঁধীজিকে মাল্যভূষিত করেন ও অভ্যর্থনা জানান। তিনি গাঁধীজিকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে এই আশ্রমের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে লেখেন, “Visva-Bharati is like a vessel, which is carrying the cargo of my life’s best treasure. Accept this institution under your protection giving it an assurance of permance if you consider it to be a national asset.বোলপুর স্টেশনে ট্রেনে বসে গাঁধীজি উত্তরে লিখেছিলেন, “Visva-Bhatari is a national institution. It is undoubtedly also international. you can depend upon my doing all I can in the common endeavour to assure its permanance.
     এর ১০ বছর পরে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সংবিধান রচনাকালে গঠিত ভারত রিপাবলিকের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও প্রথম শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল কালাম আজাদ বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় সরকারের আশ্রয় দান করেন- তখন রবীন্দ্রনাথও নেই, গাঁধীজিও নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘life’s best treasure’ গাঁধীজির প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়িত্ব ‘permanance’ অর্জন করে। গাঁধীজি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর (১৯৪১) পর শেষবার শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯৪৫ সালে দীনবন্ধু এন্ডরুজ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপনকালে।
     গাঁধীজি শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনযাত্রা দেখে রবীন্দ্রনাথের কাছে অসন্তুষ্ট হন, অনুভব করেন এই প্রক্রিয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মিক শক্তি পঙ্গু হয়ে এবং তাঁরা আত্মনির্ভর ও স্বাবলম্বনের শিক্ষা অর্জন থেকে বিরত থাকছেন। গাঁধীজির এই স্বাবলম্বনের ব্রতে অনেকেই সমর্থন জানাবার পরিবর্তে প্রতিবাদ জানান। অবশেষে ১০ মার্চ ১৯১৫ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছাত্ররা রান্নাবান্না, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া ইত্যাদি কাজ নিজেরা করার সিদ্ধান্ত নেন ও গাঁধীজির ফিনিকস্ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা পায়খানা পরিষ্কারের দায়িত্ব নেন। এই ব্যবস্থা মাত্র ৪ মাস বলবৎ ছিল। গাঁধীজি গ্রীষ্মের ছুটির পর শান্তিনিকেতন থেকে চলে গেলে পুনরায় আশ্রমে ভৃত্য ও পাচক নিয়োগ করা হয়।
     গাঁধীজির প্রবর্তিত স্বাবলম্বনের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজও ১০ মার্চ দিনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, কর্মী ও অধ্যাপকরা ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিনিকেতন আশ্রমে এলাকা পরিষ্কারের কাজে সামিল হন। এই দিনটি শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গাঁধী পুণ্যাহ’ নামে উদযাপিত হয়। কাজ আর আনন্দ এই দিনটিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আশ্রম এলাকা গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে- ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই…’ বা ‘মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ / জানিসনে কি ভাই। / তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই…’।
     শান্তিনিকেতনের প্রবীণ আশ্রমিক দ্বীপেশ রায়চৌধুরী সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বাসন মাজার কাজটাও তাঁরা ছাত্রাবস্থায় এই দিন অত্যন্ত আনন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের ‘খর বায়ু বয় বেগে’ গানের সুরে রচিত একটি ছড়া পাঠের মধ্য দিয়ে করতেন, আমরা ক’জনে বসে / থালাবাটি ঘসে ঘসে / বাসনের গাদা মাজি ভাইরে / কড়াই ডেকচিগুলো / তেলেঝোলে কালো হলো / কোথা গেল ছোবরা ও ছাইরে?’ (অবসর পত্রিকা, নবম সংখ্যা, পৃঃ ২৫)।
     গাঁধী পুণ্যাহের এই বিশেষ দিনটির একটি তাৎপর্য আছে। এই ব্যবস্থায় শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে যেমন সচেতন হওয়া যায়, তেমনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষের সাথে একটি আত্মিক যোগ অনুভবের শিক্ষাও আছে এর মধ্যে- যা একটি জীবন বোধের প্রতীক। বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালে মহাত্মা গাঁধীর আসন্ন সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পরিচ্ছন্ন ভারত গড়ার লক্ষ্যে বিগত ২ অক্টোবর ২০১৪ সালের ভারত সরকার প্রচলিত ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ নামক জাতীয় প্রকল্পের বীজ শান্তিনিকেতন আশ্রমে গাঁধী পুণ্যাহের মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল।

Advertisement
Previous articleক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে শনির বলয়
Next articleদার্শনিক সক্রেটিস ও তাঁর সহধর্মিণী জ্যানটিপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here