সন্ধ্যার কিছু আগে গাছিরা খেজুর গাছে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য ভাঁড় পেতে আসেন। সারা রাত সরু বাঁশের নলের মাধ্যমে ভাঁড়ে সেই রস জমা হয়। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সেই রস গাছিরা আবার খেজুর গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে আসেন। এদিকে বাদুড়ের অন্যতম প্রিয় পানীয় এই সুমিষ্ট খেজুর রস। ভাঁড় বা রস সংলগ্ন স্থানের ওপর বসে যখন কোনও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত বাদুড় সেই রস পান করে, তখন তার মল-মূত্র বা লালা খেজুর রস-এ মিশে যায়।

জনদর্পণ ডেস্ক : শীতের মরশুম মানেই খেজুর রস-এর মরশুম। বাংলার গ্রামাঞ্চলগুলিতে খেজুর গাছের মাথা আংশিক মুণ্ডন করে বছরের ঠিক এই সময়টিতেই একমাত্র পাওয়া সম্ভব এই ‘অমৃত তরল’। তারপর আগুনের তাপে বাষ্পীভূত করে সেই রস থেকেই তৈরি হয় নলেন গুড়। আর তা দিয়ে তৈরি হয় শীতের প্রধান উপাদান বাঙালির প্রিয় পীঠে-পায়েস।
তবে নলেন গুড়ের পাশাপাশি খেজুর রস-এর পান করার চাহিদাও নেহাত কম নেই এই শীতের মরশুমে। ভোরের কুয়াশা মাখা সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা শীতল এই পানীয় যেন সেই সময়কার জন্য অমৃতের সমান। কাঁচা অবস্থাতেই বাঙালি পান করে থাকে এই খেজুর রস। তাই ‘নিপাহ’ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চূড়ান্ত একটা সম্ভাবনাও থেকেই যায় এখানে।
কী এই নিপাহ ভাইরাস? এটি এক ধরণের RNA ভাইরাস। এই ভাইরাস প্যারামিক্সোভিরিডি ফ্যামিলির হেনিপাহ ভাইরাস গোষ্ঠীর অন্তর্গত। সাধারণত এটি একটি জুনেটিক ভাইরাস। তাই আক্রান্ত প্রাণী থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে থাকে। আক্রান্ত হওয়ার প্রথম অবস্থায় কোনও রকম উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। পরে মাথা ব্যথা, জ্বর, পেশী ব্যথা, বমি, গলা ব্যথা, তৃষ্ণা, বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। নিপাহ মানুষের মস্তিস্কে সংক্রমণ ঘটায়। তাই এই রোগ থেকে সাময়িক মুক্তি মিললেও পরে আক্রান্ত ব্যক্তি মস্তিস্কের সংক্রমণ ঘটিত সমস্যায় ভুগতে পারেন।
১৯৯৯ সাল নাগাদ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে প্রথম এই ভাইরাসের দেখা মিলেছিল। সেসময় শূকর ছিল এই ভাইরাসের বাহক। পরে ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশেও নিপাহ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৮২ জন আক্রান্ত হয়েছেন নিপাহ-তে। তাঁদের ৫৪ শতাংশই পরে মারা যান। এখনও পর্যন্ত এই রোগের উপযুক্ত কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তাই চিকিৎসকেরা বারবারই নিপাহ থেকে সাবধান থাকার কথা জানান।
তবে খেজুর রস-এর সঙ্গে নিপাহ-র কী সম্পর্ক? বিশেষজ্ঞরা এখানে সরাসরি সম্পর্ক থাকার কথা জানাচ্ছেন। পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে বাদুড় ও শূকর এই ভাইরাসের বাহক। তাদের মল-মূত্র, লালার মাধ্যমে নিপাহ খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার কিছু আগে গাছিরা খেজুর গাছে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য ভাঁড় পেতে আসেন। সারা রাত সরু বাঁশের নলের মাধ্যমে ভাঁড়ে সেই রস জমা হয়। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সেই রস গাছিরা আবার খেজুর গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে আসেন। এদিকে বাদুড়ের অন্যতম প্রিয় পানীয় এই সুমিষ্ট খেজুর রস। ভাঁড় বা রস সংলগ্ন স্থানের ওপর বসে যখন কোনও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত বাদুড় সেই রস পান করে, তখন তার মল-মূত্র বা লালা খেজুর রস-এ মিশে যায়। সেই রস কাঁচা অবস্থায় পান করলে যে কোনও ব্যক্তি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শুধু খেজুর রস নয়, বাদুড়ে ছেদন করা যে কোনও ফল খাওয়াও উচিত নয়।
তাই নিপাহ থেকে বাঁচতে কোনওভাবেই বাদুড়ের সংস্পর্শে না আসার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। খেজুর রস সংগ্রহের সময়ও সাবধানতা মেনে চলার কথা বলছেন তাঁরা। এক্ষেত্রে গাছে পেতে রাখা ভাঁড়কে যতটা সম্ভব ঢেকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। অন্যথায় খেজুর রস কাঁচা অবস্থায় পান করার পরিবর্তে কিছুক্ষণ সেই রস আগুনের তাপে গরম করে নেওয়ার কথা জানাচ্ছেন তাঁরা।