ক্রমশ বিপন্নের পথে এগিয়ে চলেছে বীরভূমের সাপুড়ে সম্প্রদায়

Advertisement
গ্রাম-বাংলার সাপুড়ে সম্প্রদায় আসলে ‘বেদে’ নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। সাপ ধরা আর সাপ খেলা দেখানো তাদের প্রধান পেশা ও নেশা। কিন্তু বর্তমানে আইন করে সাপ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই তারা এখন আর আগের মতো সাপের খেলা দেখাতে পারে না। যদিও তাদের বর্তমান প্রজন্মও এই পূর্ব পুরুষের পেশাকে ত্যাগ করতে চাই। বেছে নিতে চাই অন্য পেশা। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি

%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25B6 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25A5%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%258F%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%259A%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%259B%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%2581%25E0%25A7%259C%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%259F
সাপ খেলা দেখাচ্ছেন বাগপাড়ার ডালিম মাল

বিজয় ঘোষাল : ‘বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপু রে? / আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা…’, সুকুমার রায় রচিত এই “বাবুরাম সাপুড়ে” ছড়াটি শোনেনি এমন বাঙালি বোধহয় বঙ্গদেশে নেই বললেই চলে। এখানে সাপুড়ে বললেই বোঝাবে গ্রাম-বাংলার এক শ্রেণীর মানুষদের, যাদের পরনে লুঙ্গি, মাথায় পাগড়ির মতো একটুকরো কাপড় জড়ানো। তারই সঙ্গে ফণা তোলা সাপের উল্কি আঁকা হাতে ধরে রয়েছে বিন। সেই বিনে বারংবার ফুঁ দিয়ে, কখনওবা ডুগডুগি বাজিয়ে একদল ছেলে-ছোকরাকে দেখিয়ে চলেছে সাপের খেলা। তাদের ঝাঁপিতে তখন মজুত রয়েছে বেশ কতকগুলি বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ। এদের মধ্যে খরিস, আলান, বালিবেড়া, চন্দ্রবেড়া, কেউটে অন্যতম। আবার হলহলে, লাউডগা, ঢ্যাড়া, আদারি সহ কিছু নির্বিষ সাপেরও দেখা মিলবে তাদের ঝাঁপিতে। সাপুড়ে তার বিন বা ডুগডুগি বাজিয়ে নাচিয়ে চলেছে একের পর এক সাপকে। সেই সাথে ছোটো ছোটো গল্প বা ছড়া আউরিয়ে সাপেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেও ভোলে না তারা।
     ‘সাপ খেলা’ দেখানোর পর আগত দর্শকের কাছ থেকে জুটে যায় সামান্য কিছু অর্থ। অথবা কখনও সখনও আদায় করা হয় চাল, ডাল, তরিতরকারি। এক পাড়ায় সাপ খেলা দেখানো হয়ে গেলে, তারা চলে যায় অন্য পাড়ায়। এইভাবেই গোটা দিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে অবশেষে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। সাপ ধরে সাপের খেলা দেখানো এদের যেমন পেশা, তেমনি বংশ পরম্পরায় আর্বতিত একটি নেশাও বটে।
     কয়েক বছর আগেও এদের গ্রামে-গঞ্জে সাপের ঝাঁপি নিয়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু যখন থেকে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন কড়া করা হয়েছে, নিষিদ্ধও হয়ে গিয়েছে সাপ ধরা ও সাপ খেলা দেখানো। এরপর সাপুড়েদের আর সাপের ঝাঁপি নিয়ে তেমনভাবে দেখা যায় না গ্রাম-গঞ্জের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে।
     তবুও চিরতরে হারিয়ে যায়নি তারা। কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্বকে। বীরভূম জেলার বেশ কিছু অঞ্চলে তাদের আজও দেখা মেলে। এই জেলার নানুর ব্লকের বড়াসাঁওতা গ্রামপঞ্চায়েতের বাগপাড়া গ্রামে প্রায় ৩০-৩৫টি সাপুড়ে পরিবার বসবাস করেন। এছাড়াও ওই ব্লকের পাঁকুড়হাস, ব্যাঙচাতরা, পালিতপুর, জুলন্দী, সাঁতরা, খুঁজটিপাড়া অঞ্চলে প্রায় ৫০-৬০ পরিবার আজও ‘সাপ খেলা’ পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। কিছু সাপুড়ে (২-৪টি পরিবার) রয়েছে বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের বিনুরিয়া গ্রামে এবং সাঁইথিয়া ব্লকের ভ্রমরকোল অঞ্চলে। তবে এই সম্প্রদায়ের প্রত্যেক পরিবারই এখন বিপন্নের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে রয়েছেন।
       সাপুড়ে সম্প্রদায় আসলে ‘বেদে’ নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাই নিজেদের ‘বেদে’ বলে পরিচয় দেয় তারা। নিজেদের মধ্যে পৃথক ভাষা, সমাজব্যবস্থা, কৃষ্টি ও লোকসংস্কৃতি থাকার সুবাদে এরা তপশীলি উপজাতির তকমাও পেয়েছে। বাগপাড়ার হীরা মাল, উত্তম মাল, রাজু মাল-এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক সময়ে তাঁরা ছিলেন যাযাবর জাতি। বর্তমানে বাগপাড়ায় তাঁরা প্রায় পাঁচ পুরুষ ধরে বসবাস করছেন ও ‘সাপ খেলা’ দেখিয়ে চলেছেন। তাঁরা মনে করেন তাঁদের ‘বেদে’ নাম আরবের “বেদুইন” যাযাবর গোষ্ঠী থেকে এসেছে। আবার এঁদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, তাঁরা ১৬০০-১৬৫০ খিষ্টাব্দ নাগাদ আরাকান বা বর্তমান মায়ানমার থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছেন শারনার্থী হিসেবে। তখন থেকেই পেটের টানে সাপ, বাঁদর, ভাল্লুক খেলা দেখিয়ে যাযাবর জাতির মতো জীবন-যাপন অনুসরণ করেছেন। বাগপাড়ার বেদেরা নিজেদের “মাঙতা” মনে করেন। “মাঙতা” শব্দটির অর্থ ‘ভিগ মেগে খাওয়া’।
     বেদেদের মধ্যে জাতিভেদ না থাকলেও কাজের ধরণ অনুযায়ী তাঁরা তিনটি গোত্রের হয়ে থাকে। এদের মধ্যে যারা সাপ ধরে ‘সাপ খেলা’ দেখায়, তাদের ‘মাল মানতা’ বা ‘সাপুড়ে’ বলে। যারা ঝাঁড়ফুক করে ও সাপ নিয়ে জাদু দেখায়, তাদের ‘বাজিগর’ বা ‘মাদারি’ বলে। আর যারা কাঁচের চুড়ি ও মালা বিক্রি করে, তাদের বলে ‘সান্দার’।
     বাগপাড়া, পাঁকুড়হাস ও বিনুরিয়ার বেদেরা ‘মাল’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এরা পদবীতে ‘মাল’। এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সেই ভাষার নাম ‘ঠের’। তবে ভাষাটি সম্পূর্ণভাবে মৌখিক। এর কোনও লেখ্য রূপ নেই। সমাজের রীতি অনুযায়ী রয়েছে দলের প্রধান বা মোড়ল। যে ব্যাক্তি অন্যদের তুলনায় কিছুটা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, এদের সমাজে তাকেই ‘মোড়ল’ নির্বাচন করা হয়। এই সম্প্রদায়ের যে কোনও সামাজিক ‘সালিশি’-তে মোড়ল প্রধান বিচারকের ভূমিকা পালন করেন।
%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25B6 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25A5%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%258F%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%259A%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%259B%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0 %25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%2581%25E0%25A7%259C%25E0%25A7%2587 %25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%259F 2
সাপের ঝাঁপি
     শোনা যায় এরা পূর্বে ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। যেহেতু ‘সাপ খেলা’ দেখানোই এদের প্রধান জীবিকা। তাই পরে সর্প দংশনের ভয়ে এরা হিন্দু সর্পের দেবী মা মনসাকে পুজো শুরু করে। যদিও এদের প্রকৃত ধর্মপরিচয় এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। মা মনসা এদের প্রধান আরাধ্যা দেবী হওয়ায় প্রতি ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে জমকালো দেবী মনসার পুজো করে থাকে তারা। এই দিন প্রত্যেক সাপুড়ে দেবীর সামনে তাদের সাপ খেলা দেখায়। এই উৎসব “ঝাঁপান” নামে পরিচিত।
     বেদেরা সাপ ধরতে দারুণ পটু। মাঠে-ঘাটে, জঙ্গলে আবার কারও বাড়িতে সাপ ঢুকলে তাদেরই ডাক আসে প্রথম। পুরুষরাই এই সাপ ধরার কাজ করে থাকে। বাড়ির মহিলাদের কখনওই এই কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। সাপ ধরার পর তারা প্রথমেই সাপের বিষ দাঁত ভেঙে দেয়। কিন্তু কোনভাবেই বিষ সংগ্রহ করে বেচতে পারে না। কারণ সরকারি লাইসেন্স নেয় এদের। সাপকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা খেতে দেয় ইদুর, ব্যাঙ, পোনামাছ, টিকটিকি ইত্যাদি।
     তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা মোটেও ভালো নেই এখন। বাগপাড়া গ্রামের উত্তম মাল, ডালিম মাল, ইন্টান্ডা অঞ্চলের রিংকু মাল, বিনুরিয়া গ্রামের স্বপন মাল ও শিবু মালদের থেকে জানা গেল, বর্তমানে তারা সাপ ধরতে পারেন না। সরকারি আইন অনুযায়ী, সাপ ধরলেই জেল-জরিমানা হতে পারে। আয়ের অন্য কোনও বিকল্প উৎস না থাকায় মাঝে মধ্যে তাঁরা দূর-দূরান্তে সংগৃহীত সাপের ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। যদিও প্রশাসনিক ভয় তাড়া করে সব সময়। সারাদিনে গড়ে ১০০-১৫০ টাকা উপার্জন হয়। কোনও দিন তাও হয় না।
     তবে সাপ খেলা দেখতে এখনও সমান আগ্রহ রয়েছে মানুষের মধ্যে, জানালেন ওই সাপুড়েরা। তাঁরা আরও জানালেন, তাঁদের বর্তমান প্রজন্ম অবশ্য আধুনিক ভাবনায় শিক্ষিত। তাঁরা এই অনিশ্চিত আয়ের পেশায় আর থাকতে চাইছেন না। বেছে নিচ্ছেন অন্য কোনও পেশা।
     বেদেদের পরিবারে এখন সত্যিই সাপ খেলা দেখানোর আগ্রহ কমে গিয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তাই বাগডাঙার সাপুড়েরা এখন আর কুসংস্কারকে প্রাধান্য দেন না। সাপে কাটা রোগীকে পর্যন্ত ঝাঁড়-ফুঁক করার পরিবর্তে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ভ্রমরকোলের বেদেরাও ধীরে ধীরে সাপ খেলা দেখানো ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকরণ ও মানুষের রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে একসময় চিরতরে বিদায় নেবে এই লৌকিক পেশা। তখন সাপুড়েদের হয়তো আর গ্রামে গ্রামে ঘুরতে দেখা যাবে না সাপের ঝাঁপি নিয়ে। এরই সঙ্গে হারিয়ে যাবে তাঁদের লোকসংষ্কৃতি ও কৃষ্টিও।
Advertisement
Previous articleমাকড়সার জালেই আটকে রয়েছে যত রাজ্যের রহস্য
Next articleগ্রহাণু ‘২০২০এনডি’ কি পৃথিবীর পক্ষে বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here