করোনা শাসিত পৃথিবীতে আগামী দিনে বুদ্ধের বাণী পথ দেখাতে পারে

Advertisement
3
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : সেদিনও আকাশে এমন সোনার থালার মতো চাঁদ উঠেছিল, কপিলাবস্তুর অদূরে লুম্বিনী উদ্যানে সিদ্ধার্থ জন্মেছিলেন শাক্য উপজাতীয় গণরাজ্যের নির্বাচিত শাসক শুদ্বোদনের পুত্র রূপে ৫২৩ (মতান্তরে ৫৬৪) খৃস্ট পূর্বাব্দে সিদ্ধার্থের জন্মের ৭ দিন পরে তাঁর মা মায়া দেবীর মৃত্যু হয় মাসি ও বিমাতা প্রজাপতি গৌতমীর কোলেপিঠে বড়ো হলেন সিদ্ধার্থ অশ্বঘোষের বুদ্ধ চরিত’-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাজা শুদ্বোদন কুমার সিদ্ধার্থকে প্রাচুর্য ও পার্থিব উপভোগের মধ্য দিয়ে বড়ো করে তুলতে কোনও কার্পণ্য করেননি প্রতিবেশী কোলিও গণরাজ্যের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা ভদ্রা কোপিলায়নী বা যশোধারার সাথে তাঁর বিবাহ দেন পার্থিব ভোগ সুখে দিন অতিবাহিত হতে থাকে স্বপ্নের মতো কিন্তু কোথাও কী অন্য সুর বেজে উঠেছিল হ্যাঁ, ঠিক তাই!
     একদিন অনিবার্যভাবেই বাগিচা ভ্রমণরত সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু মানুষের চিরন্তন পরিণতি সারথি ছন্দককে প্রশ্ন করে উত্তর পেলেন কালের প্রবাহে সকলেই একই গতি প্রাপ্ত হয় এর থেকে কারও মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই
     চরম ভোগ সুখের মধ্যেও এর হাত থেকে মুক্তি লাভের প্রশ্নটা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল ইতিমধ্যেই তাঁর পার্থিব বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন পুত্র রাহুল কিন্তু কোনও কিছুই তাঁকে সংসারে আবদ্ধ রাখতে পারল না তিনি মুক্তির উপায় খুঁজতে পৃথিবীর পথে নিষ্ক্রান্ত হলেন হ্যাঁ, রীতিমতো পরিণত ২৯ বছর বয়সে গেলেন ঋষি অড়ার কলাম ও উদ্দক রামপুত্তের কাছে যোগ ও তপস্যায় শরীর শুষ্ক করে ফেললেন জীর্ণ কঙ্কালসার দেহে উপলব্ধি করলেন মজ্ঝিম পন্থার কথা অতঃপর নৈরঞ্জনা নদীর তীরে এক অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় লাভ করলেন পরম জ্ঞান বা মহাবোধী
2
বোধী বৃক্ষ
     ঘর ছাড়ার ৬ বছর পরে যে সত্য তিনি উপলব্ধি করলেন তা মানব কল্যাণে ছড়িয়ে দিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন পরবর্তী ৪৫ বছর ধরে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন তাঁর ধর্ম ও দর্শনের প্রচারে যে ধর্মে ছিল না ভগবান, সর্গনরক কিম্বা কোনও অলৌকিক জাদু বিশ্বাস ছিল না মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কথা
    তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রচার করলেন জগতে দুঃখ আছে এবং আসল কথা হল তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা বুদ্ধ নিজে বিহারের বাইরে দূরে তেমন কোথাও যাননি কিন্তু তাঁর সেই আশ্চর্য ধর্ম ও দর্শন ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে পরিব্যাপ্ত হল সমগ্র বিশ্বে
     বুদ্ধ নিজে ছিলেন গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ জন্মেওছিলেন গণতান্ত্রিক ভাবধারার মধ্যে সংঘনীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তিনি সাম্যের নীতিকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন মানব কল্যাণ ও অহিংসায় ছিল তাঁর অঙ্গীকার বুদ্ধের বাণী ও জীবন চর্চার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করার শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায় বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি এক মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ
1
মহাবোধী মন্দির, বুদ্ধ গয়া
     ৮০ বছর বয়সে ৪৮৩ খৃস্ট পূর্বাব্দে তিনি যখন তাঁর দীর্ঘ পরিক্রমণ শেষ করে কুশী নগরে মল্লরাজাদের শাল বাগানে মহাপরিনির্বাণ লাভ করতে চলেছেন তার আগে পর্যন্ত ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে তাঁর অন্তিম বাণী ছিল, “ব্যয়ধর্মাঃ সংস্কারাঃ, অপ্রমাদেন সম্পাদয়েথাঃ অর্থাৎ যা কৃত, যা সৃষ্ট, তা নাশ হবেই, শেষ হবেই তাই আলস্য না করে জীবনের মূল লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হও
     সেদিনও পূর্ণিমার চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়িয়েছিল মল্লদের শাল বাগানে উত্তরের হাওয়া কেঁপে উঠেছিল বিষণ্ণ ক্রন্দনে রাতের শেষ প্রহরে গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করলেন ভিক্ষুরা অনেকেই শোকার্ত হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন শুধু অবিচল রইলেন অনুরুদ্ধ এবং আনন্দ পরের দিন মল্লরাজারা দল বেধে এসে বুদ্ধের দাহকার্য সমাপন করলেন তাঁর পুত অস্থিভস্মগুলি ভাগ করে দেওয়া হল দাহকার্যের পর পরবর্তীকালে সেই অস্থির ওপর নির্মিত হয়েছে স্তূপ ও চৈত্য
     আজ বুদ্ধের সাম্য, একতা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিজ্ঞানসম্মত গণতান্ত্রিক চেতনা একমাত্র রক্ষা করতে পারে এই হিরণ্য গ্রহকে এই করোনা দীর্ণ পৃথিবীতে শুধুই ব্যাধি, মৃত্যু, হাহাকার! বাতাস ভারি হয়ে উঠছে মানবতার ক্রন্দনে পৃথিবীর এই গভীর অসুখের সামনে আরগ্য ও মুক্তির পথ দেখাতে পারে বুদ্ধের জীবন ও দর্শন
(ছবি : লেখক)
  • All Rights Reserved
Advertisement
Previous articleকরোনা মোকাবিলায় কার্যকারী ভূমিকা নিতে পারে প্রাচীন আয়ুর্বেদ
Next article‘দ্বারে আসি দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’ : রবীন্দ্র-জয়ন্তী ও কিছু কথা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here