ওরা হারিয়ে যায়নি, শুধু বদলে গিয়েছে ওদের পেশা

Advertisement

গ্রাম বা শহরাঞ্চলের অলি-গলিতে এক সময় ভাল্লুক বা বাঁদর নাচিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত বেদে সম্প্রদায়। প্রশিক্ষণের সময় বনের পশুদের ওপর তারা নির্যাতনও চালিয়েছে। এখন সেই ভাল্লুক নাচানোর পেশা ছেড়ে তারা বেছে নিয়েছে বিকল্প অন্য জীবিকা। ওরা পেরেছে বনের পশু বা পাখিদের মুক্ত করতে। কিন্তু এখনও যারা নিজেদের ঘরে পশু বা পাখিদের খাঁচায় বন্দি রেখেছে, তারা মুক্ত করবে কবে? – ছবি : সংগৃহীত

they are not lost only their profession has changed 3

জয়দেব দেবাংশী : গ্রাম বা শহরাঞ্চলের অলি-গলিতে দল বেধে এখন আর তেমনভাবে দেখতে পাওয়া যায় না ওদেরকে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অবশ্য আক্ষেপ করে বলে থাকেন, ওরা হারিয়ে গিয়েছে সমাজ থেকে। সত্যিই কি হারিয়ে গিয়েছে? নাকি বর্তমান সমাজের অন্দরে পুরোপুরি মিশে গিয়েছে তারা?

     এখানে ‘ওরা’ বলতে বেদে সম্প্রদায়ের কথা বলা হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে ওরা কেউই হারিয়ে যায়নি। শুধু বদলে ফেলেছে ওদের বংশপরম্পরার পেশা-কে। বেছে নিয়েছে অন্য কোনও বিকল্প জীবিকা। এই সমাজের বুকেই আর পাঁচ জনের মতোই হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে তারা। শুধু জীবিকা বদলিয়েছে বলেই সাধারণভাবে ওদের চেনা খুব দুষ্কর হয়ে ওঠে।

     এক সময় ওদের হাতেই নেচে উঠত ভাল্লুক বা সাপ। স্থায়ী বসতি কোথায় সে খবর হয়তো ওরা নিজেরাই রাখত না। ঠিক যেমন যাযাবরের মতো জীবন-যাপনে বিশ্বাসী ছিল ওরা। গ্রাম বা শহরাঞ্চলের অলিতে গলিতে ভাল্লুক বা সাপের খেলা দেখিয়ে দিনের শেষে যা কিছু জমা হত ওদের ভাঁড়ারে, তাতেই বেজায় খুশি ছিল তারা।

     বনের পশুকে কিভাবে বশে আনতে হয়, সে ব্যাপারে একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিল এই বেদে বা সাপুড়ে সম্প্রদায়। যে সাপকে সমাজের সাধারণ মানব জাতি ভয়ের চোখে দেখে এসেছে, বেদেরা তাদেরকেই বন থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছে নিজেদের ঘরে। বনের ভাল্লুক বা বাঁদরকেও বশে এনেছে খুব সহজেই। তবে স্বীকার করতেই হবে, এক সময় এই ‘বশে আনা’ বন্য পশুরা নির্যাতিত হয়েছে বেদেদের হাতে। প্রশিক্ষণের সময় অমানবিক নির্যাতন করেছে তাদের ওপর। ভাল্লুকের নাকে বেল্ট পরিয়ে এক হাতে দড়ি ও অন্য হাতে লাঠি নিয়ে চলত প্রশিক্ষণ। একটু বেসামাল হলেই ভাল্লুক বা বাঁদরের পিঠে জুটত লাঠির আঘাত।

     খেলা দেখানোর সময়ে ভাল্লুক বা বাঁদর সত্যিই কি নেচে উঠত বেদের ডুগডুগি বা বাঁশির সুরে? পশুরা কি বোঝে ডুগডুগি বা বাঁশির সুর? কখনওই নয়। নেচে উঠত সেই প্রশিক্ষণের কথা মনে রেখে। একটু বেসামাল হলেই যে জুটবে মারণ আঘাত!

     যদিও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল এই ভাল্লুক নাচ বা সাপ-বাঁদরের খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে সরকারি প্রচেষ্টায় ও কিছু সমাজসেবী মানুষের উদ্যোগে। আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে পশুদের ওপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না।

     বীরভূম জেলার রাজনগরের কাছে এরকমই একটি বেদের দলের বসতি রয়েছে। পূর্বে তাঁরা ভাল্লুক নাচিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। স্থানটি এখনও ভাল্লুকপাড়া নামে পরিচিত। তবে ভাল্লুক নাচানোর বৃত্তি তাদের আর নেই। অনেক আগেই সে বৃত্তি ত্যাগ করেছে তারা। এখন জীবন-জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছে অন্য বিকল্প পেশা।

they are not lost only their profession has changed

     বেদে বা সাপুড়েদের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। তাঁরা পূর্বে বন্য পশুদের সঙ্গে যা কিছু করেছে সবই পেটের দায়ে। সেকথা এক প্রকার স্বীকার করে এখন সে পেশা তারা ছেড়েও দিয়েছে। কিন্তু গ্রাম বা শহরাঞ্চলের এক শ্রেণীর মানুষ আজও নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য বনের পশুকে খাঁচায় বন্দি রেখে দিয়েছে দিনের পর দিন। টিয়া, ময়না, কাকাতুয়া সহ আরও হরেক রকম পাখিকে কোনও মতেই তাঁরা বন্দি দশা থেকে মুক্তি দিতে চাই না। যদিও সময় মতো খাবার দেয়, প্রয়োজনে স্নানও করায়। ঠিক যেমন সাজাপ্রাপ্ত কারাগারের কয়েদীর মতো। পাখিগুলি হয়তো প্রথম প্রথম মুক্তির আশায় ছটফটিছে বারংবার। কিন্তু যখন দেখেছে সে গুড়ে বালি, তখন বন্দি জীবনকেই বেছে নিয়েছে বাধ্য হয়ে। এই স্বাধীন দেশে তারা আজও রয়ে গেল সম্পূর্ণ পরাধীন।

     তবে ভাবতে অবাক লাগে, আজও খাঁচায় বন্দি অবস্থায় খোলা বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয় মুক্ত আকাশের স্বাধীনচেতা পশু বা পাখি। মাঝে মধ্যেই কিছু বুদ্ধিজীবীদের নজরে পড়লে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই ছবি। তবু এর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে কবে? বেদে, যে সম্প্রদায়কে এক সময় ‘সভ্য সমাজের বাবু’-রা অশিক্ষিত বা অচ্ছুৎ বলেছে, তারা আজ নিরীহ পশুদের মুক্ত করতে পারলে, ‘বাবু’-রা পারবে না কেন?

Advertisement
Previous articleএই ১০ জন উইকেট কিপারকে আজীবন মনে রাখবে ক্রিকেট বিশ্ব
Next articleনির্মাণ শুরুর ৩৩ বছর পরেও উন্মুক্ত হল না হোটেল ‘দি রাইউগিয়ং’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here