Advertisement
সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : ‘লকডাউন’ যে হবে, তা এক প্রকার অনুমান করা করা গিয়েছিল গত ১৯ মার্চ। প্রধানমন্ত্রী সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে তাঁর ভাষণে ২২ মার্চ ১৪ ঘন্টার ‘জনতা–কারফিউ’ পালন করতে অনুরোধ করেছিলেন। ভারতে করোনা সংক্রমণ দ্বিতীয় পর্যায় থেকে তৃতীয় পর্যায়ে যাওয়া আটকাতে এইরকম সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব হলেও তা খুবই প্রয়োজন ছিল।
২২ মার্চ ‘জনতা–কারফিউ’ চলার সময়কালে প্রধানমন্ত্রী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র দেশ জুড়ে ‘লকডাউন’ করার প্রস্তাব দেন। সে জন্যে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমস্ত ধরণের যাত্রীবাহী ট্রেন ও মেট্রো পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায় সারা দেশে। ২৪ মার্চ আবার একবার জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, পরবর্তী ২১ দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সমস্ত দেশ জুড়ে চলবে ‘লকডাউন’। তিনি এও বললেন, এই ‘লকডাউন’ এক প্রকার ‘কারফিউ’ বলা চলে।
২৩ মার্চ বিকাল ৫টা থেকেই এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায় বাস, ট্যাক্সি, অটো, টোটো সহ সমস্ত রকম গণপরিবহণ ব্যবস্থা। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলিও। তবে ‘লকডাউন’-এর বাইরে রাখা হয়েছে সমস্ত রকম আপৎকালীন পরিষেবা।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এইরকম পরিস্থিতি যে কোনও দিন আসবে, দেশবাসী তা কল্পনাও করতে পারেনি। সেই সঙ্গে এও ধারণা করা হচ্ছে, ‘লকডাউন’-এর সময়কাল এবং তার পরবর্তী দিনগুলি ভারতের অর্থনীতির জন্য এক গভীর সঙ্কট নিয়ে আসতে চলেছে।
দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সমস্ত রকম ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান বন্ধ, পর্যটন শিল্প স্তব্ধ। সেই সাথে বিদেশের সঙ্গেও ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বাণিজ্যিক পথ। যে পথ ধরে অর্থনীতির চাকা গড়ায়, করোনা সংক্রমণ আজ সেই পথকেই অচল করে দিয়েছে। বাজার স্তদ্ধ হয়ে পড়লে টান পড়বে রাজকোষের ওপর, এটাই স্বাভাবিক। ‘লকডাউন’ উঠে যাওয়ার পরও রাজকোষের এই বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণ হয়ে কবে আবার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে, তাও এখন অপেক্ষামান। তারপরেও করোনা সংক্রমণ আটকাতে ‘লকডাউন’-কে সমর্থন করা ছাড়া এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলাও নেই ভারতবাসীর কাছে। কারণ করোনা সংক্রমণ আটকানোর প্রথম ও শেষ পাথেয় এখন দেশ জুড়ে‘লকডাউন’।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই ২১ দিনের ‘লকডাউন’-এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এমনিতেই ভারতীয় অর্থনীতির হাল নোটবন্দির পর ধুঁকছে। ধুঁকতে থাকা এই অর্থনীতির ওপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ‘লকডাউন’।
সরকারী কর্মচারীদের ওপর এই ‘লকডাউন’ তেমন কোনও প্রভাব না ফেললেও, কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ মানুষগুলির। এই দিনগুলিতে তাঁদের ‘লক্ষ্মীর ভাঁড়’-এ টান পড়তে বাধ্য।
আমোদপুরের টোটো চালক কাঞ্চন দাস, মহেশ সাহানী, গনেশ মণ্ডলরা জানালেন, পথে মানুষজন না থাকলে টোটো চলবে না। বন্ধের বাকি দিনগুলি সঞ্চয় থেকে খরচ করতে হবে। একই কথা শোনালেন বোলপুর থেকে সিউড়িগামী বাসের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মীও। তিনি জানালেন, বাস চললে গোটা দিনে হাতে আসে ২০০-৩০০ টাকা। বাস বন্ধ থাকলে হাত একেবারেই শূন্য হয়ে যাবে। এই একই অবস্থা আমোদপুর ও সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চর্মকারদেরও।
প্রতিদিনের ট্রেনে ধূপকাঠি ফেরি করে বিক্রি করা সুমিত ঘোষ জানালেন, যেহেতু যাত্রীবাহী রেল পরিষেবা বন্ধ, তাই তাঁকে এবার ‘লকডাউন’-এর দিনগুলি ঘরেই কাটাতে হবে। এ অবস্থায় জমানো টাকা খরচ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় এখন নেই। সমস্যায় পড়েছেন কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী শহরগুলিতে কাজ করতে যাওয়া গ্রামাঞ্চলের ঠিকা শ্রমিক ও রাজমিস্ত্রিরাও। তাদের প্রত্যেককেই গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে ‘লকডাউন’-এর জন্য।
এর পাশাপাশি আরও একটি সমস্যা মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। ‘লকডাউন’-এর দিনগুলিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও কালোবাজারি যে হবে না তাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। নিত্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের পকেটে টান পড়বে। যদিও রাজ্য সরকার এই পরিস্থিতিতে সকলকে বিনামূল্যে চাল দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। শুধু চাল দিলেই কী অংসঠিত ক্ষেত্রের মানুষগুলির সকল চাহিদা পূরণ হবে? অন্যান্য ভোগপণ্য কেনার জন্যেও তো মানুষের হাতে অর্থের প্রয়োজন। ‘লকডাউন’-এর দিনগুলিতে অংসঠিত ক্ষেত্রের মানুষগুলির হাতে সেই টাকা আসবে কোথা থেকে?
করোনা আপডেট : শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত (ভারতীয় সময় ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত) সারা বিশ্বে এখনও কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৪ লক্ষ ২ হাজার ৩৮৪ জন। তার মধ্যে মারা গিয়েছে ১৭ হাজার ৫০৭ জন। ভারতে আক্রান্ত হয়েছে ৫১৯ জন। তার মধ্যে মারা গিয়েছে ১০ জন। (সূত্র : ওয়ার্ল্ডোমিটার)
- All Rights Reserved
Advertisement