গুনুটিয়া সেতু তারাশঙ্কর নামকরণের পিছনে রয়েছে তারাশঙ্কর এর বিভিন্ন লেখা থেকে উঠে আসা গুনুটিয়া ঘাট তথা মূয়রাক্ষী নদী। বীরভূমের নদীগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই মূয়রাক্ষী নদী। ব্রিটিশ আমলে এই গুনুটিয়া ঘাট ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, মূয়রাক্ষী নদীর জল ও আবহাওয়া এককালে বাংলার অন্যতম রেশমকুঠী গড়ে উঠেছিল এই মূয়রাক্ষী নদীর প্রান্তেই। যার ধ্বংসাব্বেশষ আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অতীতের সাক্ষ্য দিতে।

সুজয় ঘোষাল : দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে অবশেষে গত ১ ফেব্রুয়ারি বীরভূম জেলার লাভপুর ব্লকের মূয়রাক্ষী নদীর ওপর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে উদ্বোধন হল নবনির্মিত গুনুটিয়া সেতু। বীরভূমবাসী ও তারাশঙ্কর প্রেমীদের জন্য এ এক সুখবর, সেতুটির নামকরণ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের নামে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বামফন্ট সরকারের সময়ে ২০১০ সালে সেতুটির শিলান্যাস করেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী। সময়সীমা ছিল মাত্র দু’বছর। পরে সরকারের পালাবদল হলেও থমকে থাকে সেই কাজ। প্রায় ১৩ বছর দীর্ঘ টালবাহানা পেরিয়ে উদ্বোধন হল গুনুটিয়া তথা তারাশঙ্কর সেতু।
গুনুটিয়া সেতু তারাশঙ্কর নামকরণের পিছনে রয়েছে তারাশঙ্কর এর বিভিন্ন লেখা থেকে উঠে আসা গুনুটিয়া ঘাট তথা মূয়রাক্ষী নদী। বীরভূমের নদীগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই মূয়রাক্ষী নদী। ব্রিটিশ আমলে এই গুনুটিয়া ঘাট ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, মূয়রাক্ষী নদীর জল ও আবহাওয়া এককালে বাংলার অন্যতম রেশমকুঠী গড়ে উঠেছিল এই মূয়রাক্ষী নদীর প্রান্তেই। যার ধ্বংসাব্বেশষ আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অতীতের সাক্ষ্য দিতে। প্রখ্যাত ইংরেজ বনিক তথা রেসিডেন্ট জন চিপের আমলে গুনুটিয়া-বোলপুর সড়ক সংস্কার করা হয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য। তাই গুনুটিয়া ঘাট বীরভূমের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।
অন্যদিকে তারাশঙ্কর এর ‘তারণী মাঝি’ গল্পে আমারা এই গুনুটিয়া ঘাটের উল্লেখ পেয়েছি। তারাশঙ্কর এর এই জনপ্রিয় ছোট গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৪২ বঙ্গাব্দের শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়। গল্পের অন্যতম চরিত্র তারণী মাঝি আসল নাম বিপদতারণ ভল্লা, সে একজন প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ। বাড়ি ঝলকা গ্রামে। গুনুটিয়া ঘাটে খেয়া পারপার করে তার দিন গুজরান হয়। তারণী ছাড়াও গল্পে আমরা দেখতে পাই তার স্ত্রী সুখীর কথা। স্ত্রী সুখী ছাড়া তারণীর জীবনে অন্যতম অংশ ছিল এই গুনুটিয়া ঘাট আর মূয়রাক্ষী নদী। মূয়রাক্ষী নদীর কৃপাতেই তার অন্নের সংস্থান হয়। গ্রীষ্মকালে নদীর জল শুকিয়ে গেলে তাঁর জীবন যেন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আবার বর্ষায় মূয়রাক্ষী নদীর বানে ঘরবাড়ি সব ভেসে যায়।
তারাশঙ্কর এর এই গল্পে আমার মূয়রাক্ষী নদীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পাই, “বারো মাসের মধ্যে সাত-আট মাস মূয়রাক্ষী মরুভূমি, এক-মাইল দেড়মাইল প্রশস্ত বালুকারাশি ধূ ধূ করে। কিন্তু বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মতো ভয়ংকরী।” গল্পের এই ক্তহাগুলি নিঃসন্দেহে তারণীর কাছে মূয়রাক্ষী নদী ধারণের উৎস।
তেমনি গল্পের শেষে গিয়ে দেখা যায় এক ট্র্যাজিক পরিণতি। মূয়রাক্ষী নদীর প্রবল বন্যা বউ সুখীকে নিয়ে ঘর ছাড়া হয় সে। সুখীকে পিঠে নিয়ে মূয়রাক্ষীর বানের জলে ঝাঁপ দেয় তারণী। কিন্তু মূয়রাক্ষীর হড়পা বানে প্রিয়তমা স্ত্রী সুখীকে গলা টিপে মেরে নিজের জীবন বাঁচায় সে।
এক অসাধারণ ও শৈল্পিক নৈপূনতার তারাশঙ্কর গল্পের পরিনিতিকে এইভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন, “তারণী সুখীর দৃঢ়বন্ধন শিথিল করার চেষ্টা করল। কিন্তু সে আরও জোরে জড়াইয়া ধরিল। বাতাস-বাতাস! যন্ত্রণায় তারণী জল খামচিয়া ধরিতে লাগিল। পরমুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়। দুই হাতে প্রবল আক্রশে সে সুখীর গলা পেষণ করিয়া ধরিল।”
‘তারণী মাঝি’ গল্পের শেষ অংশটুকু নির্মম হলেও লেখকের অন্তনির্হিত বক্তব্য যেন নিহিত রয়েছে চরম মুহূর্তে মানুষের জীবনের কাছে ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। যে ‘তারণী’ কথার অর্থ যে ত্রাণ করে অর্থাৎ বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচায়, গল্পের যে তারণী বন্যার সময় ভেসে যাওয়া মানুষ জনকে বাঁচাতে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল, সেই কিনা আত্মরক্ষার তাগিদে এক চরম মুহূর্তে নিজের বউকে বানের জলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারাশঙ্কর এর এই গল্প যেন নাড়িয়ে দেয় সমাজকে।
এখন সেই গুনুটিয়া সেতু। পরিচিত পাচ্ছে তারাশঙ্কর এর নামে। আর হয়তো ফেরিঘাট নৌকা পারাপার থাকবে না, তবে তারাশঙ্কর এর তারণী মাঝি বেঁচে থাকবে তার গল্পের মাধ্যমে, সেই গল্পের গুনুটিয়া ঘাট ও বাংলার ১৩৪২ বঙ্গাব্দের মূয়রাক্ষী নদীর ভয়ঙ্কর বন্যায় সবার সামনে এসেছিল। এই গুনুটিয়া ঘাটে তারণী মাঝি জীবন চরিত্র স্থান পেয়েছিল তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কলমে।