ইদানিং বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ ও তার প্রতিকার

Advertisement
উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং উত্তর-পূর্ব ভারত সহ পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির পিছনে পরিবর্তিত আবহাওয়া ছাড়াও অরোগ্রাফির (Orography) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মেট্রো শহরগুলির মধ্যে মুম্বাই এর তুলনায় কলকাতায় বজ্রপাতের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেশি। মহারাষ্ট্রের নাগপুর, বিদর্ভ, ঔরঙ্গাবাদ, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, এই অঞ্চলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের ভারসাম্যে অভাব রয়েছে।
ইদানিং বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ ও তার প্রতিকার
Image by Nelson Jose Rita from Pixabay

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : ইদানিং বজ্রপাতের সংখ্যা অত্যাধিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঠে ঘাটে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই বজ্রাহত হচ্ছেন। গ্রামের চেয়ে তুলনামূলকভাবে শহরাঞ্চলেই বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে যেমন বজ্রপাত জনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে বাড়ির মূল্যবান বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম।

পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেট্রোলজির (IITM) সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রতিবছর ভারতবর্ষে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার লোক বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন, যা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর হারের চাইতে অনেক বেশি। এই পরিসংখ্যান যেমন গত পাঁচ বছরে মৃত্যুর হারের তুলনায় কিছুটা বেশি, তেমনি প্রতিবছরই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। IITM এর অ্যাটমোস্ফেরিক ইলেকট্রিসিটি অ্যারোসল ফিজিক্সের অধ্যাপক ড. এস ডি পাওয়ারের অভিমত, আগে সরকারিভাবে কোনও তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলেও গত কুড়ি বছর থেকে রক্ষিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে বজ্রপাতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এমনিতেই বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা এবং কিছু পরিমাণ বজ্রপাতের প্রয়োজন আছে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযোজনের জন্য। ডক্টর পাওয়ারের অভিমত, শহরাঞ্চলে যথেচ্ছভাবে গাছপালা কাটার ফলে শহরগুলিতে উত্তপ্ত অঞ্চলের (urban heat Island) সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে শহর ও তার চারপাশের এলাকার মধ্যে বায়ুপ্রবাহ ও তার পরিবেশের মধ্যে একটা বড় রকম তাপমাত্রার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে শহরাঞ্চল তুলনামূলকভাবে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হল শহরাঞ্চলে বহুতল বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট, রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন পরিকাঠামো নির্মাণের ফলে সবুজের উন্মুক্ত পরিসর কমে যাওয়া। তাছাড়া এইসব কাঠামো তাপকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে।

এছাড়াও যে কারণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল পরিবেশ দূষণের লাগামছাড়া বৃদ্ধি। শুধুমাত্র বায়ু দূষণের ফলে শহরাঞ্চলের বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বিশেষত কার্বন পার্টিক্যাল বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে এপ্রিল-মে মাসে গ্রীষ্মের সময় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি ও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অথচ মজার ব্যাপার হল, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে বর্ষার বৃষ্টিপাত শুরু হলে জুন-জুলাই মাস থেকে বজ্রপাতের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাচ্ছে।

উত্তর ভারত, মধ্য ভারত, এবং উত্তর-পূর্ব ভারত সহ পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির পিছনে পরিবর্তিত আবহাওয়া ছাড়াও অরোগ্রাফির (Orography) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মেট্রো শহরগুলির মধ্যে মুম্বাই এর তুলনায় কলকাতায় বজ্রপাতের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেশি। মহারাষ্ট্রের নাগপুর, বিদর্ভ, ঔরঙ্গাবাদ, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, এই অঞ্চলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের ভারসাম্যে অভাব রয়েছে। কিন্তু বর্ষার সময় বজ্রপাতের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এই সময় মেঘ অনেক মাটির কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে আবহাওয়াবিদগন মনে করেন, ভারতের মতো একটি বড় এবং বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক পরিবেশ যুক্ত দেশের ক্ষেত্রে বজ্রপাতের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে।

বজ্রপাতের ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে হলে, এই সময় বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের সুইচগুলি অবশ্যই অফ করুন। সম্ভব হলে প্লাগগুলি সকেট থেকে খুলে রাখুন। বজ্রবিদ্যুৎ চলাকালীন বাইরে মোবাইল থেকে কথা বলাও বিপদজনক এবং খোলা জায়গায় থাকলে প্রাণ বাঁচাতে গাছতলার বদলে মাটিতে সমান্তরালভাবে শুয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ। বজ্রপাতের সময় লোহা বা ধাতু নির্মিত কাঠামোর থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে টিনের চালের তুলনায় খড়ের চাল অনেক নিরাপদ।

তবে সার্বিকভাবে বজ্রপাত কমাতে হলে শহরাঞ্চলে সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। উঁচু বাড়িগুলিতে বজ্র নিরোধক (lightning arrester) লাগাতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধ করে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড সহ যাবতীয় গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে। বজ্রপাত রোধ করার ক্ষেত্রে তাল, খেজুর, নারকেল, সুপারি, প্রভৃতি গাছের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এমনকি আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশেও তালগাছকে বজ্র নিরোধক হিসেবে ব্যাপকভাবে রোপণ করা হচ্ছে। তবে এই সমস্ত গাছ লাগাতে হবে ফাঁকা জায়গায়, তবেই এর সুফল মিলবে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা যায় পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাতেও এই উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়বে।

Advertisement
Previous articleগহিরমাথা সমুদ্র সৈকতে জন্ম নিল প্রায় দেড় কোটি অলিভ রিডলে
Next articleভারতে ক্রমশই বাড়ছে ভোজ্য তেলের দাম : এই দাম বৃদ্ধির কারণ কী?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here