Advertisement
বিশ্বজিৎ ঘোষ : করোনা জ্বরে কাঁপছে সমগ্র বিশ্ব এখন। বর্তমান বিশ্বের মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এই মারণ সংক্রমণ। এর থেকে রেহায় পায়নি ভারতও। তাই দ্রুত লকডাউন শুরু করতে হয়েছে দেশ জুড়ে। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন বেছে নিয়েছে এই লকডাউনকে। কিন্তু দীর্ঘ লকডাউনে ঘরবন্দি হয়ে থাকাও মুশকিল। বিশেষ প্রয়োজনে অনেককেই বাইরে বেরুতে হচ্ছে একাধিকবার। আর এর থেকেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, সংক্রমণ আটকাতে বজায় রাখতে হবে সামাজিক দূরত্ব, জ্বর–সর্দি–কাশি–শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, জমায়েত এড়িয়ে চলতে হবে, আর অবশ্যই বারবার সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার ওপর বেশি করে জোর দিতে চাইছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) বিশ্ব জুড়ে বারবার করে হাত ধোয়া বা পরিষ্কার করার কথা প্রচার করছে। ইন্টারনেট জগতের সবচেয়ে বড়ো সার্চ ইঞ্জিন গুগলও যথেষ্ট সচেতনতা বৃদ্ধি করছে মানুষের মধ্যে। এক্ষেত্রে গুগল ডুডলের মাধ্যমে জার্মানি–হাঙ্গেরির চিকিৎসক ইগনাজ ফিলিপ সেমেলয়েসকেও বিশেষভাবে স্মরণ করতে ভোলেনি। এই চিকিৎসকই ছিলেন হাত পরিষ্কার রেখে সচেতনতা বৃদ্ধির পথিকৃৎ।
![]() |
ছবি : সংগৃহীত |
চিকিৎসক ইগনাজই প্রথম প্রচার করেছিলেন, হাত পরিষ্কারের মাধ্যমে কিভাবে জীবাণুমুক্ত থাকা যায়। তিনি ‘দি সেভিওর অব মাদার্স’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৮৪৭ সাল অর্থাৎ আজ থেকে ১৭৩ বছর আগে তিনিই প্রথম হাত ধোয়ার বিষয়কে প্রস্তাব আকারে তুলে ধরেছিলেন। সে সময় ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রধান রেসিডেন্ট চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগপত্র পান এই গুণী মানুষটি।
তিনি পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে পান, হাত পরিষ্কার রাখা বা না রাখার ওপরই মূলত জীবাণু সংক্রমণ বা রোগের বিভিন্ন উপসর্গ নির্ভর করে। পাশাপাশি ‘চাইল্ডবেড ফেবার’ নামে একটি রোগও খুঁজে পান সেসময়ে। ওই রোগটি অধিকাংশ নতুন মায়েদের মৃত্যু জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল। এরপরই হাত ধোয়ার বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসক ইগনাজ লক্ষ্য করেছিলেন, এর ফলে মৃত্যুর হার বা অন্যান্য রোগে আক্রান্তের হার যথেষ্ট কম হচ্ছে। তিনি শুধু প্রচার করেছিলেন, প্রসূতিদের পরীক্ষা করার আগে ভালো করে হাত ধুতে হবে এবং যে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হবে সেগুলিও ধুতে হবে। কিন্তু এরপর কি হল? স্রেফ পাগল প্রতিপন্ন করা হল ইগনাজ-কে। শুধু তাই নয়, তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল মানসিক হাসপাতালে।
তখন ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। জীবাণু নিয়ে বিশেষ কোনও ধারনায় ছিল না মানুষের মধ্যে, এমনকি ডাক্তারদেরও নয়। বিজ্ঞান তখনও লড়ছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। সে যুগে প্রসূতি মৃত্যু মানেই প্রচার করা হত প্রেতাত্মার হাতে বলি হওয়াকেই।
ঠিক সেই সময়ে ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। কিছুদিন লক্ষ্য করার পর চিকিৎসক ইগনাজের ধারণা হল, এর মূল কারণ বোধহয় অপরিচ্ছন্নতা। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের তিনি নির্দেশ দিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা করার পূর্বে তারা যেন প্রত্যেকেই ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নেন। সেই সঙ্গে প্রসূতি পরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলিও যেন পরিষ্কার করা হয়। পার্শ্ব চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ হলেও তাঁর কথা অমান্য করল না। এতে ফল হল ইতিবাচক। দেখা গেল, শুধুমাত্র এইটুকুতেই কিছুদিনের মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার কমে গেল প্রায় ৯৯ শতাংশ।
![]() |
ছবি : সংগৃহীত |
১৮৬১ সালে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর গবেষণাপত্র। সেখানে তিনি জানালেন, টয়লেট থেকে বেরিয়ে হাত পরিষ্কার করে তবেই উচিত যে কোনও ডাক্তারের রোগী দেখা। এছাড়া মর্গ থেকে বেরিয়েও পরিচ্ছন্ন হয়ে রোগী দেখা উচিত। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, মর্গ থেকে বেরিয়ে সরাসরি রোগীর কাছে এলে মৃতের শরীর থেকে কিছু অজানা উপাদান রোগীর শরীরে চলে আসে। যা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে ওই রোগীর।
কিন্তু তখন ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন জগৎ। রোগী মৃত্যুকে দুষ্টু আত্মার কারসাজি বলেই সবার ধারণা ছিল। এমনকি ডাক্তাররাও সেটাই মনে করত। তাই চিকিৎসক ইগনাজের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হল তখনকার চিকিৎসা সমাজ। ১৮৬৫ সাল নাগাদ পাগল প্রতিপন্ন করা হল তাঁকে। সেই সঙ্গে মানসিক চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল পাগলাগারদে।
কিন্তু চিকিৎসা দূরের কথা, রীতিমতো মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু হতে থাকে তাঁর ওপর। ১৪ দিনের মাথায় ক্ষত–বিক্ষত হয়ে গেলেন তিনি। প্রথমে বিষিয়ে উঠল তাঁর ডান হাতের ক্ষত স্থান। তারপর ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে, রক্তে। অবশেষে ১৩ আগস্ট ১৮৬৫ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে মারা গেলেন চিকিৎসক ইগানাজ ফিলিপ। তাঁর শেষ কৃত্যে কোনও চিকিৎসক বা তাঁর সহকর্মীদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে নিয়ে কোথাও লেখাও হল না কোনও প্রতিবেদন। সম্পূর্ণ নীরবে–নিভৃতে বিদায় নিলেন এই হাত ধুতে বলার প্রথম সচেতনতা বৃদ্ধির মানুষটি।
এই পৃথিবীতে বরাবরই যে কোনও কিছুর আবিস্কার প্রথম দিকে কেউই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। সক্রেটিস বা গ্যালিলিও গ্যালিলি থেকে শুরু করে ইগনাজ ফিলিপ সেমেলয়েস পর্যন্ত প্রত্যেককেই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু একদিন না একদিন তাঁদের দেখানো পথকেই বেছে নিয়েছে সমগ্র বিশ্ব। এখন যেমন ইগনাজের দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করেছে সবাই। করোনা সংক্রমণ রুখতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোনও বিকল্প নেই। বারবার হাত ধুতে হবে। দামি সেনিটাইজার না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, হাতের কাছে পাওয়া যে কোনও সাবানও এক্ষেত্রে একই কাজ দেবে। করোনার থেকে রক্ষা পেতে গেলে বিনা বাক্যে লকডাউন মানা এবং বারংবার হাত ধোয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরী।
সূত্র : এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, বিএমজে জার্নাল, দি ওয়াশিংটন পোস্ট
- All Rights Reserved
Advertisement