‘আলোক দূষণ’-এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য

Advertisement
আলোক দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশেষ কয়েক শ্রেণীর পরিযায়ী পাখি। তারা মূলত বহু দূরের পথ অতিক্রম করার সময় রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয়। কারণ রাতের আকাশ থাকে অনেকটাই নিরাপদ। অন্য শিকারি পাখিরা সেসময়ে বিশ্রামে মগ্ন থাকে। অন্ধকারে তাদের পথ চলতে সাহায্য করে ভূ-চৌম্বক, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া এবং বিশেষ কতকগুলি প্রাকৃতিক নিশান। বছরের পর বছর আলোক রশ্মির উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওই সব নির্দিষ্ট নিশানগুলি।

‘আলোক দূষণ’-এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য
Image by Comfreak from Pixabay

সজয় পাল : পরিবেশ দূষণের ঘটনা আজ নতুন কিছু নয়। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বিভিন্ন দূষণের মাত্রা। বায়ু, জল, শব্দের পাশাপাশি আলোও আজ সুরক্ষিত নয়। আলো নিজে দূষিত হয় না ঠিকই, কিন্তু বর্তমানে পরিবেশকে মারাত্মভাবে দূষিত করছে। আর এর বিরাট প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্যের উপর।

রাতের অন্ধকার এখন আর আগের মতো মিশকালো আঁধারে আচ্ছন্ন নেই। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামগুলিও হয়ে উঠেছে আলোকময়। শুধুমাত্র সূর্যের আলোর ওপর নির্ভর করেই দিনযাপনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। প্রত্যেকটা আলোকস্তম্ভ হয়ে উঠেছে এক-একটা ক্ষুদ্র সূর্য। যার রশ্মির ছটায় পথের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত গোচরে আসতে বাধ্য। আর সেই সুযোগে মনোরঞ্জন বা আকর্ষণ বৃদ্ধির অছিলায় উৎসবের দিনগুলির পাশাপাশি অন্য সাধারণ দিনগুলিও অত্যধিক আলোকসজ্জায় সজ্জিত হচ্ছে।

গবেষকরা ইতিমধ্যেই আলোক রশ্মির অত্যধিক বাড়-বাড়ন্ত নিয়ে জোর গবেষণা শুরু করেছেন। এই বিষয়টিকে ‘আলোক দূষণ’ হিসাবে দেখানো হয়েছে। তাঁরা গবেষণায় প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন, আলোক দূষণের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে নিরীহ উদ্ভিদ এমনকি মানুষ নিজেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে পরাগায়নের মতো নিবিড় সম্পর্ক। যে কাজটি স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির নিয়মে হয়ে থাকে। কয়েক শ্রেণীর পতঙ্গ নিজেদের অজান্তেই এই কাজটি করে থাকে নিখুঁতভাবে। পরাগায়নের জন্য অবশ্য দিন বা রাতের আলাদা কোনও সময়ের প্রয়োজন হয় না। সব সময়ই হতে পারে। রাতের ক্ষেত্রে মথ, গুবরে পোকা বা ছারপোকার মতো কিছু পতঙ্গ এতে অংশগ্রহণ করে। এই পতঙ্গরা আবার সম্পূর্ণভাবেই নিশাচর। অন্ধকারে সময় কাটাতেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করে। কিন্তু পরিবেশের বিভিন্ন ধরণের দূষণের প্রভাবে তাদের বংশ আজ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আলোক দূষণও তার অন্যতম কারণ। বর্তমানের চোখ ঝলসানো আলোক রশ্মির সম্পাতে তারা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে লোকালয় থেকে। যার প্রভাব পড়ছে উদ্ভিদের পরাগায়নের ওপর। রাতের বেলা পরাগায়ন ঘটতে না পারায় কিছুটা হলেও ব্যাঘাত ঘটছে ফল বা ফসল উৎপাদনে।

নিশাচর পতঙ্গদের মধ্যে জোনাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এক সময়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম-বাংলার পথ-ঘাট, ঝোপে-ঝাড়ে তাদের উপস্থিতি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করা যেতো। এখন তাদের দেখা মেলে খুবই কম। তার অন্যতম কারণ এই আলোক দূষণ। এদের চোখ সাধারণত আলোক সংবেদী হয়। নিজেদের জীবনযাত্রা পরিচালনার জন্যে তারা রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয় স্বাভাবিকভাবে। শরীর থেকে উদ্ভূত আলো-কে কাজে লাগিয়ে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্ক রেখে চলে। কিন্তু কৃত্রিম তীব্র আলো তাদের সেই কাজে আজ বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে তাদের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপ। পরিবেশে টিকে থাকার রসদ হারিয়ে তারা ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এক সময়ে শিয়াল বা বনবিড়ালের মতো নিশাচর পশুরাও লোকালয়ের কাছাকাছি ছোটো ছোটো ঝোপ-জঙ্গলগুলিতে অবাধে ঘুরে বেড়াতো। মানুষ তাদের ক্রমশ নিধন করেছে ঠিকই, যারা অবশিষ্ট ছিল তারাও লুপ্ত হচ্ছে আলোক দূষণের বিস্তারে। তীব্র আলোর ঝলকানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি। রাতের অন্ধকারে চুপিসারে খাদ্য আহরণে বাঁধা পেয়ে তাদের জীবন আজ গভীর সংকটে অবতীর্ণ হচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে তাদের প্রজনন ক্ষমতা। খাদ্যাভ্যাস, ঘুম বা পরিভ্রমণেও ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করছে।

বাদুর এবং বিভিন্ন প্রজাতির পেঁচার সংখ্যা বর্তমানে এতটাই কমে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্র ছাড়া তাদের আর কোথাও তেমনভাবে দেখা মেলে না। আসলে নিশাচর এই প্রাণীরা দিনের উজ্জ্বল আলোক রশ্মির সংস্পর্শ এড়িয়ে খাদ্য আহরণের সময় হিসাবে রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয়। অথচ লোকালয়ের কৃত্রিম আলোকসজ্জা তাদের চরম বিভ্রান্তির মধ্যে চালিত করছে। খাদ্যের অবস্থান সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে তারা দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

আলোক দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশেষ কয়েক শ্রেণীর পরিযায়ী পাখি। তারা মূলত বহু দূরের পথ অতিক্রম করার সময় রাতের অন্ধকারকেই বেছে নেয়। কারণ রাতের আকাশ থাকে অনেকটাই নিরাপদ। অন্য শিকারি পাখিরা সেসময়ে বিশ্রামে মগ্ন থাকে। অন্ধকারে তাদের পথ চলতে সাহায্য করে ভূ-চৌম্বক, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া এবং বিশেষ কতকগুলি প্রাকৃতিক নিশান। বছরের পর বছর আলোক রশ্মির উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওই সব নির্দিষ্ট নিশানগুলি। পরিযায়ীরা রাতের আকাশে পরিভ্রমণের সময়ে নিশানগুলির হদিস না পেয়ে বারংবার দিকভ্রষ্ট হয়ে ভুল পথে চালিত হচ্ছে। আর তাই তো প্রতি বছর তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে।

পরিবেশের উপরেও কম প্রভাব পড়ছে না। আইডিএ (Internation Dark-Sky Association)-এর মতে প্রয়োজনের অধিক তীব্র আলোক সম্পাতের কারণে প্রতি বছর অতিরিক্ত ১.২ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে উন্মুক্ত হচ্ছে। তাছাড়াও পরিবেশের নাইট্রেট মূলক তৈরিতেও বিঘ্ন ঘটছে যথেষ্ট। সাধারণত আলোর অনুপস্থিতিতে রাতের বেলা নাইট্রেট মূলক গঠিত হয়। রাতে তীব্র আলোক ঝলকানিতে সেই মূলক ভেঙে গিয়ে কার্বন যৌগ নিঃশ্বসনের হার কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের ওপর প্রভাব পড়ছে চরম।

মানুষ নিজেও কী কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? আলোর তীব্রতায় হারিয়ে যাচ্ছে তার রাতের দৃষ্টিশক্তি। প্রভাব পড়ছে দেহ-ঘড়ির উপর। মানুষের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকর্ম ঘুম, মস্তিষ্কের সাময়িক বিশ্রাম, হরমোন নিঃসরণ প্রভৃতিতে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। যার ফলে বিষণ্ণতা, অবসাদ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

আশ্চর্যের ব্যাপার, বায়ু, জল বা শব্দ দূষণের মতো অতিরিক্ত আলোক সম্পাতও যে এক ধরণের দূষণ, এই ধারণা মানুষের মধ্যে এখনও জন্মায়নি। এই বিষয়ে কোনও সচেতন বানীও প্রচার করা হয় না। তাই সবার নজর এড়িয়েই এই দূষণ ক্রমশ বিস্তারলাভ করছে পরিবেশের উপর, সমাজের উপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের প্রতিটা জীব এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই মানুষের জীবনযাত্রাও।

Advertisement
Previous articleবাইডেন-ই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট, নিশ্চিত ভোট গণনায়
Next articleবাইডেনের সঙ্গেই হোয়াইট হাইউজের বাসিন্দা হবে মেজর ও চ্যাম্প

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here