Advertisement
দীর্ঘদিন লকডাউনের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছিল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার বইয়ের দোকান সহ প্রকাশনালয়গুলিকে। সেই সঙ্গে এবার যুক্ত হল আমফান। লকডাউন ও আমফানের জোড়া ধাক্কায় সমস্ত বইপাড়া জুড়ে বুক ফাটা হাহাকার চলছে এখন। (ছবি : পার্থ সাহা)
|
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। ১৯৭৮ সালের বন্যা ও ২০০৯ সালে আয়লার পরে এত বড় সংকটের মুখোমুখি এর আগে হয়নি কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া। ছোট-বড় অসংখ্য প্রকাশকের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে আমফানের তাণ্ডবে। যত্রতত্র স্তুপাকৃত হয়ে রয়েছে ভিজে যাওয়া বই। এমনিতেই মানিকতলা, বৈঠকখানা, কলেজ স্ট্রিট, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া সহ পুরো চত্বর জল জমার জন্য রীতিমতো বিখ্যাত। এবারে আমফানের তাণ্ডবে কোথাও কোথাও কোমর বা বুক সমান জল দাঁড়িয়েছিল। এখনও পর্যন্ত কোনও কোনও এলাকা থেকে জল ছোট পামসেট চালিয়ে বের করতে হচ্ছে। সেই জলের নিচেই সলিল সমাধি ঘটেছে অসংখ্য স্বপ্নের নির্মাণের।
বইপাড়া এলাকায় বইয়ের দোকান ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য প্রকাশনার দপ্তর, প্রেস, বাইন্ডিংখানা, কাগজের আড়ত সহ প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছোট-বড় নানান প্রতিষ্ঠান। বইয়ের দোকানগুলোতে জল ঢুকে যাওয়ায় বহু মূল্যবান বই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা ছোট ছোট পথচলতি বইয়ের দোকানগুলোর। যাঁদের জিজ্ঞাসা ও আগ্রহের হাত কোনও না কোনও সময় আপনাকে ছুঁয়ে গিয়েছে। আপনার ঈপ্সিত বইটির নাম বলা মাত্র যাঁরা সেটি এক লহমায় আপনার সামনে হাজির করতেন, তাঁরা আজ বিপন্ন। দীর্ঘ লকডাউনে কোনও রোজগার না থাকায় তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। তার ওপর আমফানের করালগ্রাসে তাঁদের সামান্য পুঁজিটুকুও জলের তলায়।
বইয়ের সূতিকাগারে অসংখ্য বইসহ, ছাপা ফর্মা বই হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই সেসব এখন দুর্গন্ধযুক্ত পচা কাগজে পরিণত হয়েছে। সেসব সরানোই এখন বিরাট সমস্যা। কাজেই ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা একপ্রকার অসম্ভব। আনুমানিক ক্ষতি হাজার কোটির নিচে নয়। অসংখ্য প্রকাশক এবং ছোট ছোট বই বিক্রেতা কার্যত সর্বস্বান্ত হলেন। যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার ব্যবসায় দীর্ঘদিন থেকেই মন্দা চলছিল। তার ওপর দীর্ঘ দুমাস বইপাড়ায় কোনও কেনাবেচা নেই। লকডাউনের জেরে সবকিছুই স্তব্ধ ছিল। সেই মরার ওপরে এবার খাঁড়ার ঘা পড়ল এবার।
অধিকাংশ প্রকাশক প্রকাশনার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার কাগজ ধারে কিনে থাকেন। সামনেই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বই মরশুম। ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে তাদের ইপ্সিত বইটি হাতে পাবে সেটিও বড় প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। তার ওপর পরবর্তী বছরের বই ছাপার প্রস্তুতি এখন থেকেই চলছিল, এই অবস্থায় এই বিরাট বিপর্যয়ে প্রকাশকদের মাথায় হাত। ধার কিভাবে শোধ করবেন, সেই চিন্তাতেই তাঁদের ঘুম উড়ে গিয়েছে। যেসব ছোট ছোট বই বিপণি বড় প্রকাশকদের কাছ থেকে বই নিয়ে বিক্রি করেন, সেসব বই জলের তলে চলে যাওয়ায় তাঁরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। তার ওপর ধারে কেনা বইয়ের টাকা মেটানোর জন্য বড় প্রকাশকদের তাগাদা তাঁদের অনেককেই বিপন্ন করেছে।
অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রকাশনা ও প্রেসের জন্য ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার। বহু প্রকাশকের মাথার ওপর রয়েছে বিরাট ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা। তারও পরে কাগজ, কালি, আঁঠা সহ প্রকাশনা শিল্পের বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রকাশনা চালানোটা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশনার গুণগত মান এখন অনেকটাই বেড়েছে। রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে গেলে সারাবছর অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। তার ওপর ইদানিং অবাঙালি অনেক বহুজাতিক প্রকাশনা সংস্থা ইতিমধ্যেই কলেজ স্ট্রিটে পা রেখেছে এবং দেশি বাঙালি প্রকাশকদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই তাঁদের থাবার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এইভাবেই হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে বাংলার প্রকাশনা শিল্পের নিজস্ব ঘরানা ও ঐতিহ্য। এই পটভূমিতে আমফান এক নয়া সংকটের সৃষ্টি করল।
আমফান শুধু প্রকাশকদেরই নিঃস্ব করে দিয়ে গেল তাই নয় সেইসঙ্গে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত শ্রেণীকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেল। সন্দেহ নেই, বহু মানুষ রুটিরুজি হারালেন করোনাদীর্ণ গভীর সংকটের সময়ে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, এই বিরাট সংকট কাটিয়ে সবার গর্ব কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া কিভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বিশ্ব ঐতিহ্যের বইপাড়া হারিয়ে যাক তা কেউই নিশ্চয়ই চাইবে না। তাই সরকারকে অবিলম্বে এই সংকটের সমাধানে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকাশনাকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকদের আর্থিক সাহায্য করে বই পড়ার ঐতিহ্যময় প্রকাশনা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে বইপ্রেমী মানুষদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
Advertisement
সত্যিই খুব দুঃসময়। বইপাড়া আজ সংকটের মুখে। সোমনাথদা ঠিক কথাগুলোই লিখেছেন।