Advertisement
ঘূর্ণিঝড় আমফানের পর কেটে গিয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ। এখনও ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছেন এই অঞ্চলের বহু মানুষ। যদিও যারা পাওয়ার নয়, তারা ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে ত্রাণ। নিজের ভিটেয় মাথা গোঁজার ঠাইও করে উঠতে পারেননি অনেকে। বিদ্যুতের অভাবে রাতের পরিবেশ যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এই অঞ্চলে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
|
সৌম্যদীপ্ত বোস : একদিকে করোনার অদৃশ্য বেড়াজাল, অন্যদিকে আমফানের প্রলয়লীলার মাঝে সুন্দরবন ও সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষজনের জীবন কার্যত এখন দূর্বিসহ। এমনিতেই লকডাউনের জন্য কাজ হারিয়েছেন এই অঞ্চলের এক বিশাল সংখ্যক মানুষ। আর এবার ঝড়ের দাপটে তাঁদের শেষ সম্বল ভিটেটুকুও প্রায় না থাকার মতো। এ চিত্রটা যদিও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু আয়লা বা বুলবুলের ক্ষতে প্রলেপ লেপনে ব্যস্ত সুন্দরবনবাসীর কাছে এ নতুন বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বাস্তবিক ক্ষেত্রে বাতুলতা মাত্র।
কারও বা জমিতে নোনা জল ঢুকে ফসলের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে, কারও বা পরিশ্রমের টাকায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সাধের ঘর আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবুও ফ্যাকাসে মুখগুলোতে এখন একটাই রব ‘আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো’। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে?
ঘূর্ণিঝড় আমফানের পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ। স্থানীয়দের কথায়, এতদিন পরেও কর্তৃপক্ষের তরফে তেমন কোনও গরজ নেই এই পরিস্থিতির উন্নতিতে। সামান্য দিন গুজরানের কিছু বেসরকারী ত্রান পৌঁছলেও তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই কার্যত হাতাহাতির সৃষ্টি হয়। তার ওপর সবচেয়ে বড় অন্তরায় আঞ্চলিক রাজনীতি। ‘বাপে খেঁদানো মায়ে তাড়ানো’ এইসব লোকাল ‘গুন্ডা’-দের দ্বারা বেসরকারী ত্রান আত্মসাৎ করা বাস্তবিক সত্য বলেই ধরে নিয়েছে ভাগ্যপীড়িত মানুষজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরকম বহু খবর বেরিয়েছে, যেখানে সরকারি সাহায্য এমন কোনও মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যার এসবের কোনও দরকারই নেই। স্বভাবতই ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
কিন্তু চোখের সামনে এভাবে নিপীড়িত হওয়া গ্রামবাসীরা এতে কোনও আমলই দেন না। কারণ এ বঞ্চনা আজকের নয়, চিরকালীন। উপকূলবর্তী অঞ্চল হাঁড়া, নবদ্বীপ, হরিনারায়ণপুর, মানিকা-র অধিবাসীদের কাছে এখন একজনই ভরসা, তিনি ‘উপরওয়ালা’। কথায় কথায় স্থানীয় এক ব্যক্তি জানালেন, “আমার ছিটেবেড়ার বাড়ি। ঝড়ের ফলে তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। বউ বাচ্ছাকে নিয়ে উঠেছিলাম স্কুল ঘরে। কিন্তু এখন সেখান থেকে উঠে আসার আদেশ জারি করেছে। এখন বুঝতে পারছি না থাকব কোথায়? খাবো কী? অঞ্চল থেকে একটাও ত্রিপল এসে পৌঁছয়নি আজও”।
অনেক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা শিশুদের স্ট্রেস, পোস্ট লকডাউন ট্রমা নিয়ে রাশভারি বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে গনমাধ্যমের সাহায্যে। অনলাইনে চলছে ক্লাস। এসব দেখে বা শুনে মনে হয়, সত্যিই এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশ। অথচ গৃহহীন একপেটা খাওয়া সুন্দরবন অঞ্চলের শিশুগুলোর অধিকার নিয়ে সবাই আশ্চর্য রকম নির্বাক। কোনও রকম গণমাধ্যমের আলোতেও আসছে না এদের দুর্দিনের কথা।
যখন শহুরে পথে বিদ্যুতের জন্য মানুষ বিদ্রোহী সত্তায় অবতীর্ণ, তখন সমগোত্রীয় সুন্দরবনবাসী ভাগ্যের পরিহাসে নিরুপায়, নিরুত্তর প্রতিবাদের ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, যারা উক্ত অঞ্চলে সাহায্য পাঠাতে তৎপর তাদেরই একজন জানালেন, “আমরা জানিনা কতদিন পর্যন্ত এভাবে সাহায্য পৌঁছে দিতে পারব। কিন্তু আমরা আমাদের সামর্থের শেষ বিন্দু পর্যন্ত এ কাজে লিপ্ত থাকব”।
যখন খবর নিতে কোনও গণমাধ্যম এসব অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন দলে দলে মানুষ ঘিরে ধরেন তাদের। তাঁদের প্রশ্নবাণ এসে ভিড় করে, ‘কোথা থেকে আসছে?’, ‘কে পাঠিয়েছে?’, ‘কোনও পঞ্চায়েত থেকে আসা হয়েছে কিনা?’, এরকম হাজারও প্রশ্ন। তাদের প্রশ্নের ধরণ দেখে সহজেই বুঝতে পারা যায়, তাঁরা কতটা সাহায্যের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে আজও বসে রয়েছে নির্বাক হয়ে। তাঁদের ভিড় করে আসা এই প্রশ্নবাণের কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, “আমফানের এতদিন পরেও তেমন কোনও বড়ো ধরণের সাহায্য এসে পৌঁছায়নি তাঁদের হাতে। যদিও যারা পাওয়ার নয়, তারা ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে। গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের আঁখের।”
আমফান পরবর্তী সময়ে সুন্দরবন ঘুরে আসা গণমাধ্যমের কেউ কেউ দাবি করছেন, যদিও চির উপেক্ষিত এই মানুষগুলোর জীবন এখানেই থেমে থাকার নয়, নিজেদের কর্মবলে তারা আবার ঠিক ঘুরে দাঁড়াবেন। কিন্তু শহুরে ভাষার ট্রমা, স্ট্রেস নিয়ে যদি এঁদের মধ্যেও কেউ আলোচনা করতে এগিয়ে আসতেন, তাহলে হয়তো এই মানুষগুলো ভবিষ্যতের দিকে আরও কিছুটা উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেত। গৃহহীন শিশুরাও ছোটোবেলা থেকে শিক্ষাগ্রহণের প্রতি উদাসীনতা দেখাত না।
Advertisement