Advertisement
বীরভূম জেলার অন্য আর পাঁচটা ‘পটের গ্রাম’-এর মতো কুসুমযাত্রার পটশিল্পও এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে পটশিল্পীরা দায়ী করছেন আধুনিকতার ছোঁয়াকে। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, পূর্বে বিভিন্ন গ্রামে পটশিল্পের যেমন কদর ছিল, এখন তার প্রায় পুরোটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
|
সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল :কয়েক দশক আগেও বীরভূম জেলার বিভিন্ন গ্রামে পট আঁকার রীতি ও পটের গানের চল ছিল। ওই গ্রামগুলি আজও ‘পটের গ্রাম’ নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই গ্রামগুলিতে কদাচিৎ পট আঁকতে দেখা যায় পটুয়াদের। গ্রামগুলির হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন বাদে বাকি পটুয়ারা বেছে নিয়েছেন বিকল্প জীবিকা। কারণ প্রায় প্রত্যেকেরই দাবি, পটশিল্প এখন আর তেমন কেউ পছন্দ করছেন না।
বীরভূম জেলার কুসুমযাত্রা গ্রামটি ‘পটের গ্রাম’-গুলির মধ্যে অন্যতম। এই গ্রামটিকে ‘পৌরাণিক পট’-এর গ্রামও বলা যেতে পারে। কেননা গ্রামের প্রতিটি পটুয়া পরিবার এক সময়ে পৌরাণিক পটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন বাদে বাকিরা পটশিল্প থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। যাঁরা এখনও যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের ভবিষ্যতও ক্রমশই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে।
কুসুমযাত্রার অবস্থান বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকে। গ্রামটির দূরত্ব আমোদপুর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যে। এই গ্রামের একটি পাড়া আজও সুনির্দিষ্টভাবে ‘পটুয়াপাড়া’ নামে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এখানে রয়েছে ৪০-৫০টি পটুয়া পরিবার। তবে এতগুলি পটুয়া পরিবার থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে মাত্র পিরু, জিগর ও ধুলো পটুয়া-ই বর্তমানে পটশিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
৭৬ বছর বয়সী পিরু পটুয়া বিগত ৫০ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বীরভূম জেলার মূয়রেশ্বর থানার শিবগ্রামে। জ্যাঠামশাই পশুপতি পটুয়া, বাবা কালী পুটুয়া ও অপর এক পটশিল্পী তারণী পটুয়ার কাছে তিনি পট আঁকা শিখেছেন। রপ্ত করেছেন কীভাবে পটের গানে সুর দিতে হয়। তখন পটের কদর ছিল, তাই অতি আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পট দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। তবে এখন আর তিনি পটের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত নেই।
পিরু পটুয়ার কথায়, আগে বীরভূম সহ বিভিন্ন স্থানে তিনি “কৃষ্ণলীলা” পট দেখিয়েছেন। মানুষও অগ্রহ নিয়ে তাঁর পট দেখেছে। তখন গ্রামে দূরদর্শন ছিল না। অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতে রেডিও-র চলও তেমন ছিল না। প্রত্যন্ত গ্রামগুলির বাসিন্দারা পৌরাণিক কাহিনী অঙ্কিত পট দেখতে ও পটের গান শুনতে পটুয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকত। এখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তাঁদের কদর একেবারে নেই বললেই চলে।
জিগর পটুয়া এই গ্রামের অপর আর একজন নামী পটশিল্পী। তাঁর আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার পাঁচথুপি গ্রামে। “সিন্ধুবধ”, “মনসা মঙ্গল”, “হরগৌরী বিবাহ”, “জটায়ুবধ”, “দানখন্ড”, “সাবত্রী সত্যবাণ”, “অহল্যা উদ্ধার” প্রভৃতি জিগর পটুয়ার পটশিল্পের মধ্যে অন্যতম। তবে এগুলির মধ্যে “সিন্ধুবধ” পটের গানে তিনি বিশেষ পারদর্শী।
এককালে এই কুসুমযাত্রা গ্রামের বিখ্যাত পটশিল্পী ছিলেন মেঢ়ু পটুয়া। অনেক বিখ্যাত পটশিল্পীরাও তাঁর কাছে পট শিক্ষার তালিম নিয়েছেন। জেলার বাইরেও মেঢ়ু পটুয়ার সুখ্যাতি ছিল।
কুসুমযাত্রার এই পটুয়ারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও এঁদের হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক বিষয়ে রয়েছে অগাধ জ্ঞান। শুধু তাই নয়, তুলির টানে অনায়াসেই আঁকতে পারেন সীতা, শিব, পার্বতী, জটায়ু, মনসা ইত্যাদি বিভিন্ন দেবদেবীর অবয়ব। তাঁরা অতি সহজেই রঙ-তুলির আবহে মুছে দিতে পারেন ধর্মীয় ভেদাভেদকে। গাইতে পারেন ঐক্যের গীত। এখানে পিরু পটুয়ার “কৃষ্ণলীলা”-ই দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ কদমগাছে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে আর সেই বাঁশির সুরে গোরুগুলি বিচরণ করছে। অথবা জিগর পটুয়ার “সিন্ধুবধ”-এ ফুটে উঠছে রাজা দশরথের হাতে ঋষিপুত্র সিন্ধুর শেষ পরিণতি।
তবে পৌরাণিক আজানা ঘটনাগুলিকে এককালে গানের ভঙ্গিতে তুলে ধরে বহবা পেলেও, আজকের ডিজিট্যাল যুগে কুসুমযাত্রার এই পটুয়ারা অনেকটাই বাত্য। পিরু পটুয়া জানালেন, বছর ২০ আগেও পটুয়াদের যে সম্মান ছিল তা আজ আর নেই। সে সময়ে গ্রাম-গঞ্জে পট দেখাতে গেলে তাঁদেরকে কম্বলের আসন পেতে বসতে দেওয়া হত। বাড়ির কর্তা পটুয়াদের দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থাও করত। পট দেখানোর শেষে চাল, ডাল, নুন, তেল, সবজি, এমনকি কিছু খুচরো পয়সাও তাঁদের থলিতে ভরে দিত। কিন্তু এসবই এখন অতীত। পিরু পটুয়া পটের গান জানলেও এখন আর গাইতে চান না। কারণ, ‘এর মূল্য কেউ দিতে চাই না।’
জিগর পটুয়ার কথায়, পটের গান হারিয়ে যাচ্ছে মূলত আধুনিক বিনোদনের দাপটে। তখন পুজোর গন্ধ আসত পটের গানের সুরে। রেডিওতে মহালয়া শোনার পরও গ্রামের মানুষেরা ব্যাকুল হয়ে থাকত “পার্বতীর মর্ত্যে আগমন” বা “শিব দূর্গার ঝগড়া” পটের গানের জন্য। আশ্বিনের সকালে পটের গান শুনতে আসত কচিকাঁচারা। নীল আকাশের ঘনঘটার মধ্যে কাশফুলের দোলাচলে পটের গান যেন আরও মুখরিত হয়ে উঠত।
যদিও জিগর পটুয়া আজও পুজোর অষ্টমী ও নবমীতে কুসুমযাত্রা সহ বেশ কিছু গ্রামে পটের গান দেখিয়ে সিধে সংগ্রহ করেন। তবে পুরাণের ঘটনাবলীগুলো মানুষ এখন টিভিতেই দেখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পটের পুরাণে তাদের রুচি আসে না।
Advertisement
খুব ভালো প্রচেষ্টা 👍