‘মাহালি’ ভারতের একটি উপজাতি সম্প্রদায়। তাঁদের বংশানুক্রমিক প্রধান পেশা বাঁশ শিল্প। এই সম্প্রদায়েরই একটি শাখা বসবাস করছে বীরভূম জেলার কুচুইঘাটা গ্রামে। তবে তাঁদের তৈরি সাঁজি, পেচে, কুলো, ঝুড়ি টোকো, খলপা প্রভৃতির কদর কমছে ক্রমশ। কারণ খোলা বাজারে বর্তমানে বাঁশের বিকল্প হিসাবে বিক্রি হচ্ছে প্ল্যাস্টিকজাত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী। মানুষ বাঁশের বিকল্প হিসাবে বেছে নিচ্ছে সেগুলি। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |
সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল :ভারত তথা বাংলায় বাঁশ শিল্পের ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঁশের তৈরি ঝুরি, সাজি, পেচে, কুলো প্রভৃতির ব্যবহার হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাঁশ বাঙালি সংস্কৃতির আচার-অনুষ্ঠানেরও একটি বিশিষ্ট অংশ। বিয়ের ছাদনা তলা সাজাতে হোক বা মৃতদেহ সৎকারে নিয়ে যাওয়ার ‘খাঁটুলি’ হোক, সমস্ত কিছুতেই নির্দ্বিধায় ব্যবহার হয়ে আসছে এই বাঁশ। বলা চলে, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাঁশ বাঙালির সংস্কৃতি ও লোকশিল্পের এক অন্যতম উপদান।
বাঁশকে উপাদান করে আজও বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প জেগে রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রান্তিক অঞ্চলের একশ্রেণীর মানুষ। বীরভূম জেলার মাহালি উপজাতি এই বাঁশের উপর নির্ভর করেই এক প্রকার বেঁচে রয়েছে বলা চলে। বাঁশ দিয়ে তাঁদের তৈরি সাঁজি, পেচে, কুলো, টোকো, ঝুড়ি, খলপা আজও এই জেলার পেশাগত লোকশিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম।
বীরভূম জেলার বিভিন্ন অংশে মাহালি উপজাতির উপস্থিতি দেখা যায়। এই গোষ্ঠীরই একটি শাখা দীর্ঘদিন বসবাস করছে সাঁইথিয়া ব্লকের অন্তর্গত আমোদপুরের পাশ্ববর্তী গ্রাম কুচুইঘাটায়। বর্তমানে প্রায় ১৫-২০ ঘর মাহালি পরিবার এখানে রয়েছে। তাঁদের বাসস্থানের এই পাড়াটি স্থানীয়দের কাছে ‘মৌলিপাড়া’ নামে পরিচিত। এঁদের একমাত্র জীবিকা হল বাঁশ দিয়ে নানান রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য তৈরি এবং স্থানীয় বাজার ও বাইরের বাজারে নিয়ে বিক্রি করা।
মাহালি সম্প্রদায় :
এই সম্প্রদায়টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। ভারতের ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড় সীমান্তে এদের আদি বাসস্থান। উপজাতির এই শাখাটি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় সমাজবিজ্ঞানীরা এঁদেরকে Particularly Vulnerable Tribal Group (PVTG) বলেছেন। অনেক জায়গায় এঁরা ‘মাহে’ নামেও পরিচিত। ‘মাহালি’ নামের সঙ্গে এঁদের শিল্পকর্মেরও বেশ মিল রয়েছে। ‘মাহালি’ শব্দ এসেছে ‘মাইট’ থেকে, যার অন্য অর্থ বাঁশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এঁরা বংশানুক্রমিক বাঁশের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত।
অনেকেই এঁদেরকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন, যা আদতেই ঠিক নয়। এঁরা ভারতের উপজাতি সম্প্রদায়ে একটি শাখা। যেহেতু বাঁশ শিল্পের সঙ্গে এঁরা আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তাই এঁদের পরিচয় ‘মাহালি’। এঁরা পদবীতে ‘মাহালি’ ব্যবহার করে থাকেন। তবে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একত্রে বসবাস করায় এঁদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেকাংশই সাঁওতাল সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। যেমন এঁদের ভাষা। এমনিতেই এঁদের কথ্য ভাষা মাহালি, যা অধিকাংশই সাঁওতালি ভাষার অনুরূপ। তবে ভাষার প্রয়োগে ক্ষেত্রবিশেষ পার্থক্য রয়েছে। বীরভূমের এই কুচুইঘাটা ছাড়াও এই মাহালি সম্প্রদায়ের দেখা মিলবে মহম্মদবাজার ব্লকের আঙ্গারগড়িয়া ও তার পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে।
বাঁশ শিল্প :
পূর্বেই বলা হয়েছে মাহালিরা বাঁশ শিল্পের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় যুক্ত। বলা ভালো, বাঁশের তৈরি সৌখিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এঁদের জীবন ও জীবিকার মূল উপজীব্য। কুচুইঘাটার এই মাহালি সম্প্রদায়ের পুরুষেরা বাঁশ কেটে ছিলা বের করার কাজ করেন। আর মহিলারা সেই ছিলা রঙ করে তাকে চূড়ান্ত সৌখিনতায় রূপ দেন। বাঁশের তৈরি কুলো, ঝাঁপি, খলপা, সরপোষ, খারুই, ঝাপড়ী, টোপা প্রভৃতি দ্রব্যগুলি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করার কাজে অবশ্য যুক্ত থাকেন পুরুষেরাই।
বাঁশের শিল্পীকর্ম ছাড়াও বর্তমানে এঁরা অন্য পেশার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। বর্ষায় ধানপোতার মরশুমে এঁদের নারী-পুরুষ উভয়ই মুনিষের কাজে জোগান দেন। কিন্তু সমান্তরালভাবে চলতে থাকে বাঁশের অপরূপ শিল্পকর্ম।
বাঁশ শিল্পের সমস্যা :
কুচুইঘাটার মৌলিপাড়ার অঞ্জলি মাহালি, পঞ্চানন মাহালি, উত্তরা মাহালিরা জানালেন, বাঁশ শিল্পের বাজার কমে আসছে দিনকে দিন। এখন চলতি বাজারে প্ল্যাস্টিক দ্রব্যের ছড়াছড়ি। যার অনেকগুলিই বাঁশের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করছে মানুষ। কম দামি এই প্ল্যাস্টিক দ্রব্যের কাছে স্বাভাবিকভাবেই মাথা নোয়াতে হচ্ছে মাহালিদের বাঁশ শিল্পকে। মানুষও চাইছে বাঁশের বিকল্পকে বেছে নিতে। পূর্বে গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরে যেমন দেখা মিলতো বাঁশের তৈরি পেচে, কুলো, টোকা প্রভৃতির। কিন্তু সমাজ জীবনে পরিবর্তনের ঢেউ আসায় এসব এখন অন্তরালে জায়গা করে নিয়েছে।
তবে এটাও ঠিক, মাহালিদের এই বাঁশ শিল্পে আধুনিকতার বড্ড অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁদের বর্তমান শিক্ষিত প্রজন্ম ক্রমশই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই বাঁশ শিল্প থেকে।