গ্রামটির ভল্লা সম্প্রদায়ের পুরুষেরা এই চড়ক উৎসবের মূল কান্ডারী বা হোতা। পূর্বে এরা ধর্মবিশ্বাসে ছিল শৈব্য। ‘পাগলাভোলা’ সাধনের জন্যে এদের ‘ভল্লা’ বলে ডাকা হত বলে মনে করা হয়। রামনগরের তিনটি অঞ্চল জুড়ে এদের বর্তমান বসবাস। চড়কের পাঁচ দিন আগে থেকে ভল্লাদের বিশেষ পালন শুরু হয়। এই ক’দিনে তারা সূচিস্নান, উপোস, নানান সংযম ও ব্রত পালন করে আনুষ্ঠানিকভাবে। তখন তাদের থাকে না কোনও জাতপাত। বদলে যায় গোত্রও। ‘সন্ন্যাসী’ বা ‘শিবের ভক্ত’-ই হয় তাদের একমাত্র পরিচয়। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

বিজয় ঘোষাল : ‘চড়ক’ বা ‘গাজন’ গ্রাম-বাংলার লোকপার্বণের অন্যতম একটি উৎসব। মূলত আদি দেবতা শিবকে ঘিরে এই উৎসবের সূচনা হয়ে থাকে চৈত্রের সংক্রান্তিতে। তবে কিছু অঞ্চলে বৈশাখ বা আষাঢ় মাসের ধর্মরাজ পুজোকে কেন্দ্র করেও চড়ক বা গাজনের আয়োজন হয়ে থাকে। তবে বৈশাখ মাসে ধর্মরাজ পুজোর চড়ক অপেক্ষা চৈত্র সংক্রান্তির শিবের চড়ক অধিক জনপ্রিয়।
বঙ্গদেশের প্রায় সমস্ত অঞ্চলেই এই শিবের গাজন বা চড়ক লক্ষণীয়। বীরভূম জেলারও জায়গায় জায়গায় সুদূর অতীত থেকে চড়কের দেখা মেলে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রীতিমতো সাড়া জাগানো। এই যেমন এই জেলার মূয়রেশ্বর ২ ব্লকের উলকুন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের রামনগর গ্রামের রামেশ্বর শিবের চড়ক অন্যতম।
রামনগর ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর তীরবর্তী একটি গ্রাম। গ্রামটির মূল আকর্ষণ রামেশ্বর শিব মন্দির। শিব মন্দির ছাড়াও মন্দির চত্বরে রয়েছে লোকনাথ মন্দির, গোঁসাই মন্দির ও বহু পুরাতন একটি টেরাকোটার মনসা মন্দির। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১ চৈত্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত দত্ত বংশের রামজয় দত্ত। পূর্বে রামেশ্বর মন্দিরটি ছিল পোড়া ইটের নির্মিত। পরে অবশ্য মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে।
কৃষি নির্ভর এই গ্রামটি প্রায় সারা বছর ধরেই বিভিন্ন উৎসবে মুখর হয়ে থাকে। তবে সেসব ছাড়িয়ে চৈত্রের চড়ক উৎসব এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। রামনগর গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষের জনাসমাগম ঘটে এই উৎসবে।

গ্রামটির ভল্লা সম্প্রদায়ের পুরুষেরা এই চড়ক উৎসবের মূল কান্ডারী বা হোতা। পূর্বে এরা ধর্মবিশ্বাসে ছিল শৈব্য। ‘পাগলাভোলা’ সাধনের জন্যে এদের ‘ভল্লা’ বলে ডাকা হত বলে মনে করা হয়। রামনগরের তিনটি অঞ্চল জুড়ে এদের বর্তমান বসবাস। চড়কের পাঁচ দিন আগে থেকে ভল্লাদের বিশেষ পালন শুরু হয়। এই ক’দিনে তারা সূচিস্নান, উপোস, নানান সংযম ও ব্রত পালন করে আনুষ্ঠানিকভাবে। তখন তাদের থাকে না কোনও জাতপাত। বদলে যায় গোত্রও। ‘সন্ন্যাসী’ বা ‘শিবের ভক্ত’-ই হয় তাদের একমাত্র পরিচয়।
‘কামান’ (বিশেষ শুচি অনুষ্ঠান)-এর পর ‘ভক্ত’-রা হাতে তুলে নেয় বেতের লাঠি। তারপর তেল-সিঁদুরের প্রলেপ দেওয়া শাল জাতীয় কাঠ (যাকে নাম দেওয়া হয় বানেশ্বর) মাথায় করে ময়ূরাক্ষী নদীতে জল আনতে যায় ঢাকের বাজনা সহযোগে। চড়কের আগের দিন ভোর নাগাদ চলে ফুলখেলা, আগুন খেলা, কাঁটাঝাঁপ সহ একাধিক আত্মপীড়নের অনুষ্ঠান। এসবেতেই অংশগ্রহণ করতে হয় ‘ভক্ত’-দের। বিকেলে রামেশ্বর শিবমন্দিরের সামনেই অনুষ্ঠিত হয় হোম-যজ্ঞের। তারপর বলি দেওয়া হয় অজস্র নিরপরাধ পাঁঠা-কে।
অনুষ্ঠানের শেষদিন অর্থাৎ চড়কের দিন সকালবেলা পাশ্ববর্তী গ্রাম দেওয়ার দীঘি থেকে তুলে আনা হয় চড়ক গাছ। তারপর শুরু হয় পুজো। অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ‘চড়ক ঘোরা’। এটিই চড়কের মূল আকর্ষণ। যা দেখতেই হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। ‘চড়ক ঘোরা’-র অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে রামনগর গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তের খোলা প্রাঙ্গণে। সেখানে বিকালের হালকা আলোয় ভক্তদের যে কোনও একজন আংটি লাগানো বড় বঁড়শী পিঠে গেঁথে দড়ির টানে বন বন করে ঘুরতে থাকে ‘চড়কদন্ড’-এ। “বান ফোড়ে বান ধরে কর হে চড়ক, অভিমতের স্বর্গে যায় না হয় নরক”।
চড়কের সঙ্গে গ্রামীণ মেলার এক অদ্ভুত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চড়ক হবে, আর মেলা বসবে না, তা কি হয়! একটা ছোটো-খাটো মেলারও আয়োজন করা হয় এই রামনগর রামেশ্বর শিবের চড়ক উৎসবে। ছোটোদের খোরাক মেটাতে এই মেলা যথেষ্ট। গত বছর করোনা সংক্রমণের জন্য সমগ্র দেশ জুড়ে চলছিল লকডাউন। তাই সে বছর জাঁকজমকের কোনও বালাই ছিল না এই চড়কে। সংক্রমণ এবছরও রয়েছে। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে। তাই লোকসমাগম এড়িয়ে চড়কের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা-ই হবে এবছর উদ্যোগতাদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ।