সিউর গ্রামে রাজা শিবাদিত্য দেবী রামেশ্বরীকে নিয়ে এসে দশভুজা মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবী রামেশ্বরী বা দশভুজা বীরভূম জেলার একটি ব্যতিক্রমী ধারার দুর্গা পুজো। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য, এখানে প্রচলিত দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমার পুজো হয় না। বদলে পুজো হয় দুষ্প্রাপ্য বহুমূল্যের কষ্টিশিলা মূর্তির। দেবী রামেশ্বরী দুর্গা-কে চিরাচরিত ব্রাহ্মণদের সংস্কৃত পুঁথি পাঠে পুজো করা হয় না। পুজো পাঠের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বহু পূর্বের রাজ পরিবারের সভাসদ দ্বারা রচিত নিজস্ব পুঁথিকে। এখানে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণ নির্ণয় করা হয় ‘জলঘড়ি’-র সাহায্য নিয়ে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

বিশ্বজিৎ ঘোষ : বাঙালির সবচেয়ে বড়ো উৎসব দুর্গোৎসব এখন দ্বার প্রান্তে প্রায়। তাই সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে সাজো সাজো রব ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে এই পুজোর সূত্রপাত ঘটেছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের রাজা বা জমিদারদের হাত ধরে। মূল পুজোর পদ্ধতি সর্বত্র একই রকম থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। অবশ্য এই ব্যতিক্রমই ছিল ওই পুজোর আসল পরিচয়। যদিও সেই সব রাজা বা জমিদারদের রাজত্ব এখন আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে সেই ব্যতিক্রমী ধারার দুর্গা পুজো। যা আজও তাঁদের বংশধরেরা নিয়ম মেনে সেই ধারাতেই পুজো করে চলেছে মা দুর্গা-কে।
এমনই একটি ব্যতিক্রমী ধারার দুর্গা পুজো বহুকাল ধরে হয়ে চলেছে বীরভূম জেলার সিউর গ্রামে। গ্রামটি আমোদপুর থেকে ৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। পূর্বে এই গ্রামের নাম ছিল শিবপুর। আর এখানেই এক সময়ে (সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক) রাজত্ব করতেন রাজা শিবাদিত্য। তিনি সেসময়ে এই গ্রামে দেবী রামেশ্বরীকে নিয়ে এসে দশভুজা মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে দ্বারবাসিনী নারায়ণ নামে আরও এক দেবতাকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায়, সেসময় এই দুই দেব-দেবীর প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সিউর গ্রামে অন্য কোনও দেব-দেবীর মূর্তি পুজোর চল ছিল না।

রাজা শিবাদিত্যের রাজত্ব এখন আর নেই। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই দুই দেব-দেবীকে আজও পূর্বের মতো সমান সমাদরে নিয়ম মেনে পুজো করে চলেছেন তাঁর বংশধরেরা। দেবী রামেশ্বরী বা দশভুজা বীরভূম জেলার একটি ব্যতিক্রমী ধারার দুর্গা পুজো। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য, এখানে প্রচলিত দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমার পুজো হয় না। বদলে পুজো হয় দুষ্প্রাপ্য বহুমূল্যের কষ্টিশিলা মূর্তির।
দেবী এখানে মহিষাসুর মর্দিনী। তবে প্রচলিত ধারার বদলে দেবীকে এখানে ভিন্ন ধারায় আরাধনা করা হয়। দেবী রামেশ্বরী দুর্গা-কে চিরাচরিত ব্রাহ্মণদের সংস্কৃত পুঁথি পাঠে পুজো করা হয় না। পুজো পাঠের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বহু পূর্বের রাজ পরিবারের সভাসদ দ্বারা রচিত নিজস্ব পুঁথিকে। সেই পুঁথি সেসময়ে রচিত হয়েছিল তামার ফলকে এবং তা রাখা হত রূপোর বাক্সে। পুঁথির একটি অংশে প্রমাণ স্বরূপ অঙ্কিত ছিল এই রাজবাড়ির গঠন ও তার নকশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অমূল্য সেই পুঁথিটি চুরি হয়ে যায়।
এখানে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণ নির্ণয় করা হয় ‘জলঘড়ি’-র সাহায্য নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়ায়। এই জলঘড়ির ব্যাপারটি কিন্তু বেশ কৌতূহলের। একটি মাটির পাত্র জলপূর্ণ করে তার ওপর একটি খালি অপেক্ষাকৃত ছোটো তামার পাত্র রেখে দেওয়া হয়। এই তামার পাত্রটির নিচে খুব ক্ষুদ্র একটি ছিদ্র থাকে। সময়ের ব্যবধানে ওই ছিদ্র পথে জল প্রবেশ করে ধীরে ধীরে পাত্রটি জলপূর্ণ হয়ে যায়। এবং সেটি ডুবে যাওয়ার মুহূর্তকে ‘পল’ বলে গণনা করা হয়। এখানে ‘পল’ শব্দটি সময়ের একক হিসাবে ধরা হয়েছে। এই পল গণনার জন্য আবার নির্দিষ্ট কাউকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হয়। তিনি চুনের দাগ কেটে পলের হিসাব রাখেন। এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে, সন্ধি পুজো যদি দিনের বেলা হয়, তাহলে পল গণনা সূর্যোদয়ের পরই শুরু হয়ে যায়। আর রাতের বেলা সন্ধি পুজো হলে, সূর্যাস্তের পর শুরু হয়। তবে গত বছর গণক প্রয়াত হওয়ায় জলঘড়ির সাহায্য নিয়ে সন্ধি পুজো হয়নি।

এখানে মহানবমীতেও বিশেষত্ব থাকে। দিনে নবমীর পুজো সমাপ্তির পরে রাতেও আবার পুনরায় নবমীর পুজো করা হয়। তখন গর্ভগৃহ থেকে দেবী রামেশ্বরী দুর্গা-কে বাইরের বারান্দায় বের করে আনা হয়।
এই রামেশ্বরী মায়ের মন্দিরে শারদীয় দুর্গা পুজো ছাড়াও রামনবমী, সীতানবমী, আষাঢ়ে নবমী ও মহানবমীও অনুষ্ঠিত হয়। এক সময়ে এখানে মহিষ ও ছাগ বলির চল ছিল। যদিও সেই বলির প্রথা এখন আর নেই। তবে বলির ‘রামদা’ আজও সংগৃহীত রয়েছে।
সিউরের দুই কিলোমিটার ব্যবধানে চাঁদপুর গ্রামে রাজা শিবাদিত্যের প্রতিষ্ঠিত সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে অবশ্য শুধুমাত্র দশমীর দিনেই পুজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, রাজা শিবাদিত্য রাজবাড়ির অবস্থান অনুযায়ী, উত্তর-পূর্ব কোণে শিবিক্ষা মন্দির এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এই সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এখানে দেবী সর্বমঙ্গলা হল মঙ্গল ও আরোগ্যের দেবী।
রাজা শিবাদিত্যের প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরগুলি কবে নির্মিত হয়েছিল, তা আর জানা যায় না। তবে কোনও কোনও সূত্র বলছে, পাল বংশের সম্রাট রামপালের রাজত্বকালে রাজা শিবাদিত্য দেবী রামেশ্বরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রামপালের আমলে বাংলায় বেশ কিছু ভাস্কর্যের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। অনেকের মতে দেবী রামেশ্বরী ও দ্বারবাসিনী নারায়ণের কষ্টিশিলার মূর্তি দুটি সেই ভাস্কর্যেরই অন্যতম নিদর্শন। ঐতিহাসিক দিক থেকে যার মূল্য অসীম।
তথ্য সূত্র : তাপস সিংহ (রাজ পরিবারের সদস্য) ও শ্রীকুমার রায়